রাহুল দাশগুপ্ত





বাক্‌ ১৪১ ।। চুনোপুঁটি




বিষ্ণু বোস বললেন, লেখাটা তোমাকে পাল্টাতে হবে সায়ন !
কেন স্যার ? জানতে চাইল সায়ন
না, এটার কিছু সমস্যা আছে
আচ্ছা, স্যার সায়ন একটু চুপ করে থাকে তারপর বলে, আপনার একটা সাহায্য চাই স্যার...
হ্যাঁ, বলো...
স্যার, আমার বাবার ক্যানসার ধরা পড়েছে একজন ভালো ডাক্তারের সন্ধান দিতে পারেন? আপনার তো অনেক চেনাজানা  যোগাযোগ
বিষ্ণু বোস কী যেন ভাবলেন তারপর বললেন, হোমিওপ্যাথি করাও না ভালো চিকিৎসা আছে
সায়ন হতাশ হল সে আর কিছু বলল না বিষ্ণু বোসের নিজের ক্যানসার হলে তিনি কী করতেন? হোমিওপ্যাথি দেখাতেন? লোকটা আসলে ভয়ানক স্বার্থপর ওর মতো চুনোপুঁটির বাবা বলেই বলেই পাত্তা দিল না স্রেফ ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলল এসব লোক পাঁকাল মাছের মতো কীভাবে এড়িয়ে যেতে হয়, কাকে এড়িয়ে যেতে হয়, সব জানে
গাড়িটা এখন একটা ছোট গলিতে ঢোকার মুখে সায়ন বলল, স্যার আমাকে একটু এগিয়ে দেবেন ? আর একটা স্টপ গেলেই আমি স্টেশনের অটো পেয়ে যাব নইলে আরো ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা বাড়ি ফিরতেই অনেক রাত হয়ে যাবে, স্যার...
বিষ্ণু বসুর দামি, এসি গাড়িটা সাইজে বিরাট বোঝাই যায়, কতটা ধনী হলে এরকম একটা গাড়িতে চড়া সম্ভব! মনে মনে গাড়িটার তারিফ করল সায়ন বিষ্ণু বসুর কোম্পানির সে সরাসরি এমপ্লয়ী নয় মাঝেমাঝে বিশেষ কাজের জন্য তার ডাক পড়ে ওইসব কাজে সায়নের কোনও জুড়ি নেই সায়নের ওপর তাই তিনি বিশেষ ভরসা করেন সায়নের ধারণা, শুধু ভরসা নয়, স্নেহও করেন
বিষ্ণু বসু আজ নিজেই বলেছিলেন, চলো, আমার গাড়িতেই যাবে তোমাকে কিছুটা এগিয়ে দেবো স্টেশনের দিকেই যাব তো...
আসলে কথায় কথায় অনেক রাত হয়ে গেছিল সায়ন ছিল নির্বাক শ্রোতা বিষ্ণু বসুই বক্তা একতরফাভাবে তিনি কথা বলে গেছেন আজ তাঁকে কথায় পেয়ে বসেছিল ভালো শ্রোতা পেলে কর্তাব্যক্তিদের এরকম হয় তাঁর খেয়ালই ছিল না, সায়নকে বাড়ি ফিরতে হবে আর সেটা অনেক দূরে সায়নের বাড়িতে তার বৃদ্ধা মা, তার ফেরার অপেক্ষায় না ঘুমিয়ে ভাত বেড়ে বসে থাকবেন সায়নের যে আজ দেরি হয়েছে, তার ডে কোনওভাবেই বিষ্ণু বসু এড়াতে পারেন না অতএব সায়ন যাতে ঠিক সময় বাড়ি পৌঁছয়, তার দায়িত্বও তাঁর ওপরই বর্তায়
কিন্তু বিষ্ণু বসু ঠিক ততটুকুই যাবেন, যতটুকু তাঁর ফেরার পথে পড়ে তার বাইরে তিনি  অতিরিক্ত একটুও যাবেন না এমন নয় যে তাঁর বিশেষ একটা তেল পুড়বে এমন নয় যে তাঁর বিশেষ একটা সময় নষ্ট হবে এমন নয় যে তাঁর বাড়ি ফেরার কোনও বিশেষ তাড়া আছে গিয়েই আজ রাতের মধ্যেই কোনও কাজ সেরে ফেলতে হবে না, এমন কোনো বাধ্যবাধকতাই তাঁর নেই তবু তিনি যাবেন না আর এটাই তাঁর শ্রেণীচরিত্র একজন নগণ্য, তুচ্ছ ব্যক্তির জন্য, এক চুনোপুঁটির জন্য তাঁর মতো বিশিষ্ট মানুষ একাজ করতে পারেন না
কিন্তু সৌজন্যবোধ দেখিয়েই আপদ বিদায় করতে হবে প্রস্তাবটা নাকচ করতে হবে
বিষ্ণু বসু তাই বললেন, বিদেশ থেকে একটা দরকারি ফোন আসবে, বুঝলে? আমার পক্ষে তো এখন...
সায়ন যা বোঝার বুঝে নিল বিদেশ থেকে ফোন এলে মোবাইলে আসবে তার জন্য বাড়ি ফিরতে হবে কেন ? নাকি ল্যান্ডলাইনে আসবে? সে যাই হোক, তাকে  প্রবল শীতে ঘন্টাখানেক স্টেশনেই থাকতে হবে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে হেঁটেই যেতে হবে একটা বাস স্টপ এত রাতে সে কিছুই পাবে না ওদের মফঃস্বলের স্টেশনে নেমে বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে যাবে তারপর জুটবে খাবার সেই দুপুরবেলায় স্টেশনেই সামান্য একটু খেয়ে নিয়েছিল এখন খিদের চোখে চোখে সে অন্ধকার দেখছে!
সায়নকে নামিয়ে দিয়ে বিষ্ণু বসু নিজের বাড়ির গলিতে ঢুকে গেলেন আজ রান্নার মেয়েটি চমৎকার বিরিয়ানি রান্না করেছে ভাবতেই তাঁর নাকে সুস্বাদু খাবারের গন্ধ ভেসে এল সুখের আমেজে তিনি চোখ বুজলেন সায়ন টলতে টলতে, ধুঁকতে ধুঁকতে শীতের অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে লাগল তার মতো একটা গরিব ছেলেকে সমাজের দেওয়া এইসব শাস্তিকে আমল দিলে চলে না ...



অনেকদিন পর বিষ্ণু বসুর ফোন পেয়ে একটু অবাকই হয়েছিল সায়ন  ভেবেছিল, বিষ্ণু বসু হয়তো বিদেশে আছেন দেখা করতে চাইছেন উনি সায়নের দেখা পাওয়ার জন্য মাঝেমাঝেই এইভাবে উতলা হয়ে যান সায়ন দেখা করল আসার সময় হঠাৎ বৃষ্টি নামে সামান্য একটু ভিজতে হয়েছে সায়নকে তাই পাঁচ মিনিট পরই সে আর সামলাতে না পেরে বিকট শব্দে হাঁচি মারল
বিষ্ণু বসু চমকে উঠলেন বললেন, তোমার সর্দি হয়েছে? সর্বনাশ ! ফোনে বলবে তো? তাহলে তোমাকে আসতে বলতাম না!
কেন, কী হয়েছে স্যার?
সামান্য একটা হাঁচি নিয়ে বিষ্ণু বসুকে এইভাবে উতলা হতে দেখে যারপরনাই অবাক হয়ে গেল সায়ন।
আরে, কী আর হবে ! আমি তো সবে হাসপাতাল থেকে ফিরলাম আমার লাংসে একটা ইনফেকশন হয়েছিল...
তা এখন কেমন আছেন, স্যার? সুস্থ তো?
হব না? বিষ্ণু বসু বললেন ডাক্তারের একটা টিম চোদ্দ দিন ধরে আমার ট্রিটমেন্ট করেছে স্পেশাল কেয়ার নিয়েছে বেস্ট ট্রিটমেন্ট দিয়েছে যেদিন রিলিজ করে, কয়েকজন এসে তো প্রণাম করে অটোগ্রাফ পর্যন্ত নিয়ে গেছে ! ওরা নাকি সবাই আমায় চেনে, আমার কথা জানে, আমার লেখা পড়েছে, নিউজ পেপারে আমার ছবি দেখেছে...
শেষে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, স্যার? সায়ন বলল আপনার যে হোমিওপ্যাথির ওপর খুব ভরসা বলে জানতাম...
হঠাৎ কী যেন মনে পড়ায় বিষ্ণু বসু জানতে চাইলেন, তোমার বাবা কেমন আছেন?
নেই স্যার সায়ন বলল গত মাসেই তো...
আহা ! বিষ্ণু বসু চুপ করে গেলেন আর কিছু বললেন না
সায়ন মনে মনে ভাবল, আপনাদের প্রাণের অনেক দাম, স্যার আর আমার বাবা...
বিষ্ণু বসু তখন সায়নকে একটা বই দেখাতে ব্যস্ত সেই বইতে নামজাদা সব লেখকের লেখা ছাপা হয়েছে সায়নের লেখাটা তিনি ছেপেছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায় আত্মপ্রচারের জন্য পোস্টও দিয়েছিলেন লেখাটার অনেকেই প্রশংসা করে  কিন্তু বইতে তিনি লেখাটা রাখেননি
নামজাদা লেখকের পাশে একটা চুনোপুঁটি!
সায়ন ব্যাপারটা বুঝতে পারল বিষ্ণু বসুর কথা অনুযায়ী লেখাটা সে বদলায়নি সে গরিব হতে পারে, কিন্তু অন্যের কথায় নিজের লেখা বদলাবে কেন? অন্যের কথায় তার মতামত বদলে যাবে? অনুভূতি? এটুকু আত্মসম্মানবোধ তার আছে
বিষ্ণু বসু ভেবেছিলেন, সায়নের অভাবের সুযোগ নিয়ে তাকে নিজের সুবিধামতো কিছু লাইন লিখিয়ে নেবেন লেখাটা তাই তিনি সায়নকে পাল্টাতে বলেছিলেন সায়ন আপোশ করেনি বিষ্ণু বসুকেই আপোস করতে হয়েছিল লেখাটা তিনি ফেলে দিতে পারেন নি তাঁকে নিয়ে কেউ যদি আধখানা শব্দও লেখে, সেই শব্দটাও তিনি যত্ন করে নিজের ড্রয়ারে রেখে দেন ফেলে দিতে পারেন না তারপর গোটা দুনিয়ার কাছে সেটা তুলে দেখান, এই দেখো, আমাকে নিয়ে কী  লেখা হয়েছে...
তাই বলে যখন একটা বই হচ্ছে, তখন কী সেখানে একটা চুনোপুঁটিকে রাখা যায়? লোকে জানতে চাইবে না, সায়ন কে? সায়নকে খামোখা উনি প্রমোট করতে যাবেন কেন? ওনাকে যারা প্রমোট করবে, উনি তাঁদের নামই শুধু নিজের স্বার্থে, নিজের প্রচারের জন্য ব্যবহার করবেন সায়ন বইটা ফিরিয়ে দিল তারপর বিষ্ণু বসুর দিকে তাকিয়ে বলল, চমৎকার ঠিক বলছ?
হ্যাঁ, স্যার
তোমার মতামত আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ
জানি স্যার
কথাটা বলার সময় দলা পাকিয়ে থুতু উঠে এসেছিল সায়নের মুখে এত ঘেন্না করছিল ! সে চকচকে, উজ্জ্বল, মার্বেল পাথরের দামি মেঝের দিকে মুখ নামিয়ে নিল...

2 comments:

  1. খুব সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে নগ্ন সত্য। এই খেলাই তো এই সময়ের পপুলার গেম। যে সব বিষ্ণু বসু অক্লান্ত খেলে যেতে পারে, তারা সিঁড়ি বেয়ে সিংহাসনে গিয়ে বসে। আম জনতা মুগধ চোখে চেয়ে থাকে, ভেতরের খেলা টের পায় না।

    ReplyDelete
  2. অনেকাংশে ধোঁয়াটে। বেশ কিছু ডিটেলসের প্রয়োজন তৈরী হচ্ছে কিন্তু এড়িয়েও যাওয়া হচ্ছে সন্তর্পণে। যা হোক, মূলতঃ এদুটি মানুষের শ্রেণীচরিত্র মোটা দাগে উন্মোচিত করবার উদ্দেশ্য হয়তো এতটা স্পষ্টভাবে না বলে তাদের আচার ব্যবহারের মাধ্যমেও তুলে ধরা যেত। অবশ্য আমার পাঠ ও অভিজ্ঞতা নামমাত্র, বা তাও নয়। ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন।

    ReplyDelete