বাক্‌ ১৪১ ।। সম্পাদকের চশমায়



কোয়ারেন্টিন।
বাংলা তর্জমায় ‘সঙ্গরোধ’।
দু’ মাস আগেও ক’জন অভিধান ঘেঁটেছেন বিশেষ শব্দার্থের খোঁজে, বলা শক্ত। বাংলা প্রতিশব্দটি বরং মনে হত সেদিন আরও দুর্বোধ্য। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ না পেরোতেই আজ লাতিনজাত শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত ইতিহাস অবধি কণ্ঠস্থ হয়ে গিয়েছে বিশ্ববাসীর। সৌজন্যে জীবন ও জড়ত্বের ধূসর সীমানায় (গোদা বাংলায়, বিশদ বিশ্লেষণে যাচ্ছি না) অস্তিত্বশীল বিশেষ এক আণুবীক্ষণিক জীবাণু— উপযুক্ত জীবদেহের আধার যার মধ্যে ফুটিয়ে তোলে জীবনের লক্ষণ।
          সামাজিক দূরত্ব।
এই শব্দবন্ধটিও অপরিচিত নয় আজ আর। জীবনের স্বার্থে গোটা বিশ্বকে বেছে নিতে হয়েছে যে বিকল্প পন্থা।
অস্পৃশ্যতার দীর্ঘ ইতিহাস আমাদের দেশের। স্বার্থপর সময়ে আমাদের বেঁচে থাকা। অতিমারী-পূর্ব সময়ের কথাই ভাবা যাক। বন্ধ কপাটের আড়ালে পচন ধরেছে আত্মহন্তারক প্রৌঢ় নিঃসঙ্গ দম্পতির মৃতদেহে। দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করলে ফ্ল্যাটের অন্যান্য বাসিন্দারা খবর দিয়েছেন পুলিশকে। সামাজিক মাধ্যমে দু’-একদিন অতঃপর মেতে থেকেছি আমরা আত্মহননকারীকে অনুকম্পা দেখানো উচিত নাকি, সেই তর্কে। সন ২০২০ বিলীন হয়ে যাবে একদিন দূর ইতিহাসের কালপর্বে। কিন্তু অতীতের পথে-প্রান্তরে বিচরণরত ভাবীকালের ইতিহাসবিদ ঠিকই অনুভব করে নেবেন ২০১৫, ২০১৮ বা ২০১৯ সনেও এই সমাজের অন্তরঙ্গে যথেষ্টই ক্রিয়াশীল রয়ে যাওয়া সেই সামাজিক দূরত্বের বাস্তবতাটিকে।
‘শারীরিক দূরত্ব’ শব্দবন্ধটুকু হয়তো যথাযথ হতে পারত আজকের পরিস্থিতিতে। তবে যে সামাজিক দূরত্ব রচিত (পড়ুন কায়েম) হয়েই গিয়েছিল বিগত বছরগুলিতে, সেই প্রেক্ষিতেই হয়তো আর চলতি শব্দবন্ধটির ব্যবহার কানে লাগেনি আমাদের। বরং উক্ত সামাজিক দূরত্ব তথা উচ্চাবচতায় অভ্যস্ততার সূত্রেই অতিমারী কবলিত দেশ থেকে প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে এই স্বার্থপর সমাজের অবিবেচক সন্তান আমরা ক্ষুণ্ন করেছি সুস্থ প্রতিবেশীর সঙ্গে নিজের শারীরিক দূরত্বের আবশ্যিকতাকে।
পরিণামে সারা দেশ আজ গৃহবন্দি। এই অসময়ে বিশুদ্ধ সাহিত্যের ভূমিকা নেহাত কম নয়। মনে রাখা প্রয়োজন, একদিকে যখন আক্ষরিক অর্থেই ঘরে ঢুকে পড়েছে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম জীব, অন্যদিকে তখনই নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে প্রকৃতি। মনুষ্য-রচিত দূষণের মাত্রা হুহু করে কমতে না কমতেই যমুনার স্রোত হয়ে উঠছে স্বচ্ছতোয়া। অনেক দশক পর জলন্ধর থেকে দৃশ্যমান হচ্ছে ২৩১ কিলোমিটার দূরের হিমালয়। রাজপথে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে ময়ূর, হরিণ বা হাতির মতো প্রকৃতির অপরাপর সন্তানেরা। ইউরোপ মহাদেশে ফিরে আসছে পরিযায়ী পাখির দল। বিজ্ঞানের মদে কি অতিরিক্ত ডাকাবুকো হয়ে উঠেছিলাম আমরা? শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি— একবিংশ শতকেও এক-আধবার আত্মসমীক্ষণ প্রয়োজন মানুষের। উন্মত্ত গতিতে ছেদ টেনে দরকার একটুখানি আধ্যাত্মিক যতির।
সেই লক্ষ্যেই নির্বাচিত কিছু গল্প ও কবিতায় সাজানো হল বর্তমান সংখ্যাটি।
আত্মানং বিদ্ধি।


আবেশ কুমার দাস