শুভংকর গুহ

বাক্‌ ১৪১ ।। লিজুইন সারাহ




লিজুইন সারাহ কোনো উদ্ভিদের নাম নয় দূরবর্তী কোনো চিহ্নের নামও নয়। বহুদূর থেকে ভেসে আসা বিপ বিপ শব্দের মতো... জঙ্গল পার হয়ে হলুদ ঘাসের গ্রাম। না তাও নয় কল্পনায় ভেসে থাকা পাখির ডানার মতো, অনেকটা নদীর মধ্যে পাথরের ওপরে বসে থাকা ভিজে ডানা ছড়ানো পানকৌড়ি ঠিক যেমন। জানালার কপাট খুললেই লিজুইন সারাহ উপস্থিত হয় নিসর্গের মতো। আলোছায়ায় উদ্ভাসিত একটি টিমটিম জনপদ যার অভ্যন্তরে বিস্তৃত আছে বহুদিনের পরিত্যক্ত বিকল একটি স্টিম ইঞ্জিন। রেললাইনটি ডুবে গেছে মাটির গভীরে। বড় বড় পেল্লাই ঘাসের ডগা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। খাটাশ শেয়ালের অবাধ বিচরণক্ষেত্র। মাঝ বরাবর ভাঙা পিচের রাস্তা। রাস্তার ওপরে ভাঙা বাড়ির ইট-পাথর পড়ে আছে, সরানোর কেউ নেই।
একটু এগোলেই একটি সুন্দর বাড়ি। ঝকঝকে রং, সামনে বাগান। দেয়াল বলতে অধিকাংশই নানা  রঙের কাচ। একবারে দেখলে মনে হতে পারে, চারদিকে ছড়ানো ভগ্ন জনপদের উদাসীনতার মধ্যে একটি পরিপাটি নিখুঁত স্থির বিবরণ।
নীলাভ মনে করে একদিন এখানে পৌঁছে যাবে বলে। সবকিছু তার গুছিয়ে রাখতে বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
ঠিক এইখানেই ঠিক যেভাবে যাওয়ার রাস্তাটি ভেবে রেখেছে সেই ভাবেই সে লিজুইন সারাহতে পৌঁছে যাবে, এমনটাই ভেবে রেখেছে নীলাভ। সকালের দিকে তার কিছু  কাগজপত্রে সই করার থাকে, খুব জরুরি এবং জরুরি নয়, এমন সব জমা কাজের কিছুটা সেরে নিয়ে একবার ঘোড়ার আস্তাবলে প্রবেশ করে। খবরের কাগজের পাতার ওপরে কয়েকটি ঘোড়ার লাইন ড্রয়িংয়ের অভ্যাস করে নিয়ে, তারপরে সাইকেল চালিয়ে পৌঁছে যেতে হয় কাঁচা বাজারের দোকানে। আরও অনেক পরে, যথারীতি টবের ওপরে কয়েকটি ফুলের গাছে জল দেওয়ার শেষে, বাড়ির কাচের জানালার ছায়ায় বসে চোখ বুজে তাম্বাকু সেবনের পরে, রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে পাখির মাংস রান্নার ঘ্রাণ নিতে নিতে লিজুইন সারাহ তার কল্পনার আস্তানার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে থাকে। একটু পরে পেল্লাই কাচের গ্লাসে, কে যেন রেখে যাবে গ্লাস ভর্তি লিকার, সঙ্গে কিছু চিনাবাদাম।  সে ঘুমচোখে আমোদে লিকারে চুমুক দিয়েই শব্দটি উচ্চারণ করে, লাফিয়ে উঠবে। হ্যাঁ, অনেক কাজ যে গুছিয়ে নিতে অনেক দেরি হয়ে গেল। কাঁচামালের দোকানদার মনোহর আলি তাকে বলেছিল, বেশি দেরি করবেন না, থলিয়াটা নিয়ে যাবেন, গুছিয়ে রেখে দেব সব।
কাঁচাবাজারের দোকানে মনোহর আলি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল তার জন্য। ব্যাগের ভিতরে আপেল, পিঁয়াজ, গাজর, বিট, ব্রকলি, মটরশুঁটি, নটে শাক, সয়াবিনের প্যাকেট— তালিকায় দাম লিখে এক ব্যাগের এক কোণে ফেলে রেখেছে। মনোহর আলি দোকান চালাতে চালাতে বারেবারে পশ্চিম দিকের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে দেখছিল নীলাভ এসে পড়ে কিনা। কিন্তু বাজারের তো কিছু নিয়ম আছে, খরিদ্দার ফাঁকা হয়ে গেলে, বাজারের মেজাজ ঝিমিয়ে পড়ে। দোকান ঘিরে ফলের ওপরে ভ্যানভ্যান মাছি তাড়ানোর জন্য তখন বেশ সময় পাওয়া যায়।
যেদিক দিয়ে নীলাভ আসে, সেই দিকের রাস্তায় তাকিয়ে দেখল মনোহর, রাস্তাটা যেন আজ অনেকটাই বেঁকে গেছে। প্রতিদিন রাস্তাটিকে মনোহর আলি বেশ সোজা দেখে। সেই সকালেই নীলাভ বলে গেছিল, ব্যাগের ভিতরে ফল অন্যান্য জিনিস সব গুছিয়ে রাখতে। আপেলের পাশে পিঁয়াজ যেন রেখে দেয়। আশেপাশে কয়েকটা শসা, যাতে খুব তাড়াতাড়ি সে খুঁজে পায়।
তার লিজুইন সারাহ যাওয়ার আছে। সকাল থেকেই নীলাভ চেষ্টা করছে। কোনো কাজেই তার যেন বিলম্ব না হয়। নীলাভ সকাল থেকে যতই চেষ্টা করছে, কিন্তু তার দেরি হয়ে যাচ্ছে। স্নানের বালতির জলে নীলাভ রোজ কয়েক ফোঁটা ডেটল ফেলে দিয়ে তারপরে জল হাত দিয়ে নেড়ে ঝরনার জলের পাউডার শরীরে মেখে নেওয়ার কল্পনা অনুভব করে আত্মতুষ্টি লাভ করে। আজ তার প্রতিদিনের ছন্দে বিঘ্ন ঘটে যাচ্ছে।
নীলাভর স্ত্রী উপা বলল, সে কি? আজ তোমার এত তাড়াতাড়ি স্নান হয়ে গেল যে?
নীলাভ বলল, আজ একটু তাড়াহুড়ো আছে।
ও বুঝেছি, কারখানায় আজ তোমার জরুরি কাজ আছে বুঝি?
নীলাভ লোহালক্কড়ের পতন ও ঠোকাঠুকির শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। বড়-বড় লোহার চাকতির পতনের শব্দ নীলাভর কানের ভিতরে আঘাত করছিল ক্রমশ। ঘড়ঘড় করে মেশিন চলছিল। কোনো একটি মেশিনের বেল্ট ছিঁড়ে যাওয়ার ফলে, শব্দটি আস্তে আস্তে বহুদূরে সরে গেল। কারখানা জুড়ে আগুনের লেলিহান আর ইস্পাতের দাপট, তাকে কাঁত করে দিচ্ছিল। লোহা ও লোহার ঘর্ষণে ইস্পাতের চাকা থেকে আগুনের ফুলকি বৃষ্টির ফোঁটার মতো মাটিতে গড়িয়ে পড়ছিল।
উপা কয়েকদিন ধরে লক্ষ করছিল, নীলাভ কথায় কথায় বেশ অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। কোনো প্রশ্ন না করলেও নিজেই মনে মনে কথার পিঠে কথা সাজিয়ে বলে যাচ্ছে বেশ কিছু কথা যেমন পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার কথা বলতে গিয়ে, জুড়ে দিচ্ছে সাইনবোর্ড বা মনিহারি দোকানের কথা। রেল স্টেশনের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছে, খড়-বিচালির হাটের কথা। নদীর সঙ্গে চিড়িয়াখানা বা বাণিজ্যিক সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে পাবলিক ইউরিনাল বা ন্যাপথলিনের প্যাকেট এমন সব যুক্তিহীন উদাসীন অনাত্মীয় উপাদান, যা শুনে যে কেউ ধরে নিতে পারে নীলাভর মস্তিষ্কে চূড়ান্ত অঘটন ঘটে গেছে।
খাওয়ার দেওয়া হয়েছে?
উপা বলল, অনেকক্ষণ।
আজ মাংস খাব না। মাংস খেলে পাহাড়ের নীচে ধাবার বেঞ্চে বসে মদ খেতে খুব ইচ্ছে করে। আর জানো তো মদ আমি একা-একা... একটা উদাসীন বাতাসের স্পর্শ পাচ্ছ? ওই দিকের জানালাটি আফ্রিকা মহাদেশের মুখোমুখি, খাবার টেবিলে ফল রেখেছ?
কী করে রাখব? তুমি কি সকালে আর মনোহর আলির দোকানে গেলে?
দেখেছ ভুলেই গেলাম। তুমি আমার, ব্যাগের সাইডপকেটে জলের বোতলটা গুঁজে দিও তো। অনেকটা পথ। কতবার বাস পালটে যেতে হয় জানি না।
কোথায় যাবে?
লিজুইন সারাহ। 
কী বললে?
লিজুইন সারাহ। 
সে আবার কোন জায়গা?
তুমি কাঁধে ব্যাগ রেখে বেরিয়ে পড়বে, হাঁটতে হাঁটতে ঠিক তোমার অচেনা একটি জায়গার নাম নিজে থেকেই মনে করবে। যেমন নিজের মনে মনেই কল্পনা থেকেই শব্দ বসিয়ে একটি জায়গার নাম, সেই নাম ভেবেই তুমি এগিয়ে যেতে থাকবে, কল্পনার আশ্রয় করে আর ভেবে নেবে, চলো একবার আবার অচেনা হয়ে যাই, কিন্তু কোনো প্রত্যাশা না করেই এগিয়ে যেতে থাকবে। যখন এগিয়ে যাবে, তখন সেই যেখানে যাবে ভেবে বসে আছো, যাচ্ছ‌, সেই জায়গাটির নাম তখন লিজুইন সারাহ।
আমি এরকম কোনো জায়গার নাম শুনিনি।
শুনবে কী করে? আমি তো বললাম, তাৎক্ষণিক ভেবে নেবে, তারপরে সেই ভাবনাকে স্থায়ী করে ভেবে নেবে, একদিন দেখবে তোমার কল্পনার সঙ্গে তোমার স্বাভাবিক আচরণ মিলেমিশে যাচ্ছে। আমি যেমন, ভেবে নিয়েছি— লিজুইন সারাহ। আমার কাছে লিজুইন সারাহ এখন বাস্তব, যেখানে আমার গন্তব্য স্থির হয়ে আছে।
অনেকক্ষণ টেবিলে খাবার পড়ে আছে।
তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে।
তুমি যাওয়ার আগে, মনোহর আলির দোকানে রাখা ব্যাগটা দিয়ে যেও।
সেই সময় আমার হবে না।
তা কেন?
নীলাভ যাওয়ার আগে তার কাজের টেবিলের কাছে এগিয়ে এসে আজকে এবং বেশ কয়েকদিন ধরে, লিখে রাখা গৃহস্থ ও পোষ্য কথাগুলির ওপরে দোয়াতের কালি ঢেলে দিল। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, পিঠে ব্যাগটা নিয়ে, ব্যাগের ভিতর থেকে উঁকি দিতে থাকল একটি রাইফেলের নল ও দূরবিন। উপা তাই দেখে চমকে উঠল। লোকটা পাগল হয়ে গেছে নাকি। তাহলে ও কি জঙ্গলে যাচ্ছে শিকার করতে?
টেবিলের ওপর থেকে কাপড় চুঁইয়ে চুঁইয়ে দোয়াতের কালি টপটপ করে পড়তে থাকল।

আজ প্রায় এক বছর হয়ে গেল, নীলাভ সেই যে চলে গেল, লিজুইন সারাহ থেকে আর ফেরেনি। টেবিলের ওপরে দোয়াতের গড়িয়ে পড়া কালির দাগ, দগদগে হয়ে জেগে আছে। উপা বারান্দায় বসে বসে নীলাভর সোয়েটারের উলের কাঠি ঠোকাঠুকি করতে গিয়ে, শুনতে পেল শহরের মধ্যস্থল থেকে উঠে আসছে তীব্র জোরালো সাইরেনের শব্দ।
আকাশে তখন প্রলয়, প্রবল বৃষ্টিপাতের গভীর মেঘ।

2 comments:

  1. একটা সুন্দর মনস্তত্ত্বকে আঁকলেন। অপূর্ব।

    ReplyDelete
  2. যেন এরকম একটি উপসংহার ওই পাহাড়ি জনপদের নামেও আঁকা হয়ে আছে। লিজুইন শব্দটি, খুঁজে দেখলাম, একটি মালয়শিয়ান নাম। সারা, ইংলিশ বানানে Sarah, সেক্ষেত্রে হিব্রু ভাষার নাম, যার অর্থ রাজকুমারী। বাইবেলে সারা নামে একটি চরিত্র আছে। দুই মিলিয়ে যদি কোন অর্থ দাঁড়ায় তা গুণগতভাবেই অলীক, কাছাকাছি খুব গোদা উদাহরণ হিসেবে টানা যায় সুনীলের দিকশূন্যপুরের নাম। কিন্তু ছোটগল্পের এত নিয়ন্ত্রিত পরিসরে সুনীল তার নীললোহিতকেন্দ্রিক বন্য একঘেয়েমী কতদূর নিভাঁজ রাখতে পারতেন সন্দেহ। পাহাড়ী পথের সর্বক্ষণের কুয়াশা, তার আনপ্রেডিক্টিলিটি এ গল্পের ভাষার বৈশিষ্ট্য। অবশ্য নীলাভ-র ব্যাগে রাইফেলের উপস্থিতি ও উপার সন্দেহ - কোনটাই সেভাবে দানা না বাঁধায়, নীলাভকে ঠিক শিকারী টাইপ হিসেবে নেওয়া গেল না। আবার এই তুচ্ছ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি একটা শ্বাপদ অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স টানতে পারে। নীলাভ আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল বা কাউকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে - সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য যার সবটাই পাঠকের হাতে সাদা কাগজ গুঁজে লিখতে দিয়েছেন লেখক। এজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।

    ReplyDelete