গলির বাঁকেই বাড়িটা। লাগোয়া রোয়াকে বসেছিল সুকান্ত। ছয়-সাতের বেশি হবে না সেদিন অঞ্জন। ফিরছিল ছোটমাসির হাত ধরে। দু’-একটা কথাই হতে পেরেছিল সুকান্তর সঙ্গে। পথঘাট, অলিগলির সব জট চেনা থাকে না সেই বয়সে। জানতে হয় না রাস্তাঘাটের নাম। তাতে অবশ্য ছিল না কুছপরোয়া। নিজের মনেই ছকে নিত মিছিমিছি একটা কিছু। ওভাবেই ভেবে নিয়েছিল সেই নামটাও।
সুকান্তর
গলি।
মিছিমিছি
বাদবাকি নামগুলো কিন্তু টিকল না বেশিদিন।
ধোপার
পুকুর পার করে ললিতকলার দিকে যেতে পেল্লায় দুটো বাড়ির মধ্যিখান দিয়ে চিলতেটুকু
পায়ে চলা পথ। রেলিং
ঘেরা, ছাউনির ঘেরাটোপে ঢাকা আদ্যিকেলে ওভারব্রিজটার তলা দিয়ে হেঁটে পেরোতে হত
গলিটা। দু’পাশের দুটো বাড়ির
দোতলার মধ্যে ব্রিজটার মারফত চলত যাতায়াত। সেই ব্রিজওয়ালা গলির নিঝুম লোকালয়টাই
হঠাৎ একদিন বদলে গেল মিত্রপাড়ায়।
শাস্ত্রীপাড়ার
দক্ষিণ সীমায় টঙের ওপর নৃসিংহর মুদিখানার দোকানটা। গা ঘেঁষে নাকবরাবর পশ্চিমে চলে
যেত জানমহম্মদ ঘাট রোডের রাস্তা। রেশনের লরি চলত বলে নৃসিংহর দোকানে নিয়ে গেলে
মোটেই হাত ছাড়ত না ছোটমাসি। চাল-চিনির হিসেব যখন চলছে এদিকে, চোখ থাকত ওপারের
শুয়োর-চড়া গলিটায়। পার
হলেই জমজমাট অরবিন্দ রোড। সেই শুয়োর-চড়া গলিটাও কবে একদিন বদলে গেল যোগেন
ব্যানার্জি রোডে।
রেশনের
গোডাউন আর মুখোমুখি বাঁদর পোষা বাড়িটার পর জানমহম্মদ ঘাট রোড যেখানে হাল ছেড়ে দিত,
দক্ষিণে ঘুরে যেত রাস্তা। চওড়া চওড়া ভিডিয়ো ক্যাসেট রাখা দোকানটা থেকে মেশিন এনে দেখা
হয়েছিল ‘অ্যাই মেরে, হামসফর’ গানের সিনেমাটা। আর-একটু এগোলেই ঢালু হয়ে রাস্তাটা
নেমে যেত ফেরিঘাটে। সেই ঢালু রাস্তাটাও হয়ে গেল একদিন বাজার ঘাট রোড।
কিন্তু শেষ
অবধি টিকে গেল সুকান্তর গলি নামটা।
সুকান্তকেই
যেহেতু হারিয়ে ফেলল অঞ্জন। আর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেল গলিটাও। ছেলেটাকে যে আর খুঁজে
পাওয়া যাবে না, বুঝতে পারে ইদানীং। এভাবেই আচমকা হারিয়ে যায় সুকান্তরা। পরিণামে
অলিগলির জট না জানা সেই বয়সে ঠিক কোন বাড়ির রোয়াকে যে সেদিন বসেছিল সুকান্ত,
হারিয়ে ফেলতে হয় সেই হদিসটুকুও। সুকান্তর খোঁজ আর না পেলেও মন্দ হত না গলিটাতে
আর-একবার ফিরে যেতে পারলে। অনেক বছর ধরে সুকান্তর গলিটাকেই তাই খুঁজছে অঞ্জন।
আর খুঁজে
পায়নি বলেই টিকে আছে সুকান্তর গলি নামটা।
অজন্তা
বলেছিল, গলি হারিয়ে ফেলেছিস? সে আবার কেমন কথা?
ঠিক তাই।
হারিয়ে গেছে আস্ত একটা গলি...
কিন্তু গলি
হারায় কেমন করে?
আসলে
যেখানে ছিল গলিটা, ঠিক সেখানেই আছে। হয়তো দু’বেলাই যাতায়াত করছি ওখান দিয়েই...
তাহলে!
তবুও
হারিয়ে ফেলেছি। যাতায়াত করলেও টের পাচ্ছি না যে এ-ই সেই গলি। ওই রোয়াকেই বসেছিল
সুকান্ত। কান ঘেঁষে গিয়েও এই যে টের না পাওয়া, হারিয়ে ফেলাই তো হল...
যুক্তিটা
মনে ধরেছিল অজন্তার। মাঝেমধ্যেই
খবর নিত খোঁজাখুঁজির। এত আগ্রহে কখনও-সখনও অবাক হয়েছে অঞ্জনও। সচরাচর দেখায় না তো
কেউ এত উৎসাহ! নিজের রক্তের লোকেই ঘামায় না মাথা। অজন্তারও কি ছিল অমন কোনও ফেলে
আসা গলি! কৌতূহল হলেও আর মুখ ফুটে জানতে চায়নি। সব কথা জিজ্ঞাসা করা যায় না
মেয়েদের।
কল্পনার
জাল এগিয়ে যায় অনেকদূর। কী হলে কী হতে পারত আর কী হতে কী হল না, এসব নিয়েই মানুষের
জীবন। বাস্তবটা হল, যে বয়সে পেরিয়ে এসেছে সুকান্তর গলি, সেদিন চিনত না অজন্তাকে। চেনার
সুযোগ কিন্তু ছিল। আর যে বয়সে এসে আবার খুঁজছে গলিটাকে, সেই খোঁজাখুঁজিতে অদ্ভুত আগ্রহ
দেখাচ্ছে অজন্তা। এতটাই
যে মনে হবে গলিটার সন্ধানে রয়েছে সে-ও। যেন উভয়েরই অতীতটা বাঁধা পড়ে আছে গলিটার
পার্থিব অস্তিত্বের সঙ্গে। অজন্তার নাম অঞ্জন রেখেছিল অ্যাথেনা।
এক-একদিন
মনে হয়েছে, ভাল হত সুকান্তকে হারিয়ে ফেলার সেই আগের বয়সটাতেই অ্যাথেনার সঙ্গে দেখা
হলে।
হয়তো একটা
দিকই দেখেছিল। বা
সেভাবেও বলা হয় না পুরোটা। আসলে সুকান্তর গলির খোঁজ করা মানুষদের নিয়ে মুগ্ধতাও
যেমন থাকে অ্যাথেনাদের, সেই মানুষদের চরিত্রে একরকম জেদও দেখতে চায় তারা। আর বলতে কি ওই জেদটুকু
বাদ দিলে সত্যিই নামা যায় না গলিটার খোঁজে। আর পাঁচটা মানুষ বরং ভাববে উলটোটাই।
মনে করবে সবাই যখন ছুটছে নতুন নতুন রাজপথ, নতুন নতুন দিগন্তের পেছনে, সেই যুগে
কবেকার এক হারিয়ে ফেলা গলির মোহে মজে থাকা দুর্বলতা বই আর কি! কিন্তু সেই রাজপথ,
সেই দিগন্তদের নেশা ভুলে মনেপ্রাণে সুকান্তর গলিকেই খুঁজে চলায় আসলে যে প্রয়োজন একরকম
মানসিক কাঠিন্য, তা বুঝবে কেবল অ্যাথেনারাই। আর তাই সেখানে একফোঁটা খামতিও সহ্য
করবে না তারা।
পিয়ালিকে
বলেছিল অজন্তা, অঞ্জনকে অন্যরকম ভেবেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ও-ও আর পাঁচটা বাঙালি ছেলের মতোই হয়ে
গেল।
আর অঞ্জনকে
বলেছিল, তুই যা করেছিস ঠিক করিসনি পিয়ালির সঙ্গে।
বলার
চেষ্টা করেছিল অঞ্জন, আমি অনেক সময় অনেককে অনেক কথা বলিনি। যা বলা নিশ্চয়ই উচিত
ছিল। অবশ্যই ভুল সেগুলো। কিন্তু চেয়েছি কিছু দেখেও না দেখলে যদি শেষ অবধি আরও অনেক
সুকান্তদের ধরে রাখতে পারি জীবনে, তো তাই ভাল। একটা জীবনে আর কতগুলো গলি খুঁজব?
তাই সেই
খোঁজাখুঁজি থেকে নিষ্কৃতি নিতে নিজেকে বদলেছিস! এত সহজে হারিয়ে ফেলিস না নিজেকে। আর জানিস তো সবার
কাছে ভাল থাকার জন্য সত্যিটা না বলাটা আমি আবার ঠিক নিতে পারি না। নিজেও করি না।
তুই এভাবে
বললি আমায়?
আমি খুব
স্পষ্ট করে স্পষ্ট কথাটা বললাম। এই মানসিকতা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলিস না আর।
অজন্তার
অভিযোগগুলো যে মিথ্যে নয় খুব ভাল করে জানে অঞ্জন। আজকাল ভাবে, সত্যিই অনেক
অন্যায় হয়ে গিয়েছে পিয়ালির সঙ্গে। প্রথম অন্যায়টা বোধহয় স্রেফ রাগাতেই পিয়ালিকে মেডুসা
নাম দেওয়া। অ্যাথেনার সঙ্গে মিলিয়ে। অথচ সত্যিটা হল, খুব কমই দেখা যায় অজন্তা-পিয়ালির
পর্যায়ের বন্ধুত্ব।
মেডুসা বলে
খেপালেও সুকান্তর গলি নিয়ে কথা হত পিয়ালির সঙ্গেও। জানতে চেয়েছিল পিয়ালি, কীভাবে
খুঁজছিস গলিটা?
হুঁ হুঁ
বাবা। মাথা খাটাতে হয়েছে একেবারে গোয়েন্দার মতো...
বটে। শুনি
কেমন গোয়েন্দাগিরি করছিস।
বলছি তো।
কথার মাঝখানে এত ফোঁস ফোঁস করিস কেন রাক্ষুসির মতো? দেখছিস তো কেন নাম দিয়েছি
মেডুসা...
দাঁড়া। ভুলে যা কী করার কথা
ছিল তোর জন্যে...
বাজে কথা
রাখ। শোন যা বলছি। দ্যাখ, প্রথমত লাগোয়া ঘরবাড়ির একটা আবছা আদল আজও মনে আছে আমার।
আর সেদিন ছোটমাসির সঙ্গে বেরিয়েছিলাম একটু বেলার দিকেই। খুচখাচ দরকারই ছিল হয়তো
কিছু। বেশিদূর যাইনি। আর সুকান্তকে যখন ওখানে বসে থাকতে দেখি তখন ফিরছি আমরা।
এগুলো পরপর মেলালে যা দাঁড়ায়, শাস্ত্রীপাড়া থেকে খু—ব বেশি হলে আধা কিলোমিটারের মধ্যেই
ছিল গলিটা। তাহলে
শাস্ত্রীপাড়াকে মাঝে রেখে আধা কিলোমিটার রেডিয়াসের একটা বৃত্ত টানলে তার মধ্যেই
পড়ছে গলিটা। তাই
না! কীরে মেডুসা রাক্ষুসি, চুপ মেরে গেলি যে একদম...
শুনছি তোর
কথা। শুনতে শুনতে আমারও
মনে পড়ছে সেই বাড়িটাকে। আমি অবশ্য হারিয়ে ফেলিনি তোর মতো। সেদিন ওই রাস্তা দিয়ে যেতে
যেতে দেখালামও ছেলেকে...
অঞ্জনের
যেমন গলিটা, পিয়ালিরও ছিল অমন একটা বাড়ি। অবশ্য বাড়িটাকে হারিয়ে ফেলেনি সে। ক্যানিংহাম
রোড দিয়ে আসার পথে দেখিয়েওছে সেদিন ছেলেকে, বাড়িটা দ্যাখ উজান। এই যে জানলার
কাচগুলো। তুই কিন্তু রাত্তিরে এলেও দেখতে পাবি না ঘরের ভেতর কী আছে-না আছে। কিন্তু
ভেতর থেকে ওরা সারাদিনই দেখতে পাচ্ছে সব। এই যে গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আমরা...
ভাগ্যে ছিয়ানব্বই
সালে দূরদর্শনের পর্দায় আসেনি বিজ্ঞাপনটা। নইলে কাচের মোহেই না পণ করে বসত পিয়ালি—
বিয়ে করবে ওই বাড়িতেই। ইনকাম ট্যাক্সের বড় অফিসার ছিলেন গৃহস্বামী ভদ্রলোক। জানলায়
বসিয়েছিলেন কালো কাচ। শহরতলিতে সেই আমলে অমন কাচের জানলাওয়ালা বাড়ি রীতিমতো
দ্রষ্টব্য। স্কুলফিরতি পথে জানলার সামনে গিয়ে উঁকিঝুঁকি জমাত তমালিকা, পিয়ালি,
পায়েলরা। মুখ ভ্যাংচাত। একটু যারা ভীতু, হয়তো মানা করত, করিস না। দেখতে পাচ্ছে
কিন্তু ওরা ভেতর থেকে...
বাড়িটাকে হারিয়ে ফেলেনি পিয়ালি। যেভাবে অঞ্জন হারিয়ে
ফেলেছে গলিটা।
এখানেই ফারাক। পুরনো
ধ্যানধারণা বদলে যাচ্ছে ইদানীং অঞ্জনের। এতকাল জানত, আসলে অনেককিছু ফেলে আসতে হয়, হারিয়ে ফেলতে হয়
মেয়েদেরই। বরং
ছেলেদেরই থাকে না তত দায়। ইদানীং মনে হয়, আসলে কিছুই হারিয়ে ফেলে না মেয়েরা। শুধু
দায় থাকে বলেই ভাব করে হারিয়ে ফেলার। আর সচেতন ভাবে সেই ভাব করে যেতে হয় বলেই আসলে
রয়ে যায় সবকিছুই। কথায় বলে, প্রথম প্রেম কখনও ভোলে না মেয়েরা। ছেলেদের নামে তো কই
বলা হয় না তেমন কিছুই। বোধহয় দায় থাকে না বলেই অবহেলায় অনেককিছু শেষ অবধি হারিয়েই
ফেলে ছেলেরা।
যেমন হারিয়ে ফেলেছে সে। শুধু লাগোয়া ঘরবাড়ির আবছা
একটা আদলে ভর করে খুঁজে পাওয়া সহজ হবে না আজকের দিনে। সেই চেহারাছবি আর তেমনই আছে
নাকি কে জানে! হয়তো কত পালটে গিয়েছে মাঝের এই এতগুলো বছরে। তবে খোঁজটা থামাবে না।
এই কথাটাই ইছামতীকে বলেছিল পিয়ালি। খোঁজ থামাতে
চায় না অঞ্জন। ইছামতীর
যুক্তি ছিল পুরনো ক্ষতমুখ পথ করে দ্যায় শুধু নিত্যনতুন আঘাতকেই। এসব মায়াঝুল জমিয়ে
রাখা শুধুই অপরিণত মনের বিলাস। সেই বাড়ি ছেড়ে হয়তো কবেই উঠে গিয়েছে সুকান্তরা। পিয়ালি
বলেছিল, খোঁজ থামিয়ে দিলেই কি আর মুছে যায় স্মৃতির সেই আবছা আদল?
ছোটবেলার বন্ধুত্ব পিয়ালি ও ইছামতীতে। সেই সুবাদেই
হতে পেরেছিল এত কথা। আর যেহেতু অত গভীর কথা তখনও শুরু হয়নি অঞ্জনের সঙ্গে ইছামতীর।
সম্পর্কটা সহজ হতে অঞ্জনকেও বুঝিয়েছিল ইছামতী। এবং অঞ্জনের মুখেও সেদিন পিয়ালির
যুক্তিরই প্রতিধ্বনি শঙ্কিত করেছিল তাকে। বরং যদি প্রথম দিন ইছামতীর কথাতেই সায়
দিত পিয়ালি, এবং দু’জনের কথাই পায়ে ঠেলে তারপরও গলিটার খোঁজ চালিয়েই যেত অঞ্জন,
সমস্যা হত না। আসলে ঘরের মানুষের মনের খোঁজ নিজের থেকে বেশি রাখা নারীকে মেনে নিতে
পারে না কোনও মেয়েই। যতই থাক না কেন সেই সম্পর্কে প্লেটোনিক পবিত্রতা। যতই ঘটকালি করুক না
কেন সে উভয়ের মধ্যে। কৃতজ্ঞতা
ভুলে যেতে তিলমাত্র দেরিও করবে না এক্ষেত্রে কোনও মেয়েই।
পাকেচক্রে অজন্তার চোখেও নিছক আর-একটা বাঙালি ছেলে
হয়ে গেল অঞ্জন।
হইহই করে কেটে গেল মাঝের ক’টা দিন।
যাকে নিয়ে এই অভাবিত ওলট-পালট, সেই সুকান্তর গলিই
চাপা পড়ে গিয়েছিল নতুন জীবনে প্রবেশপর্বের হট্টগোলে।
যদি বা মনে পড়েছে মুহূর্তের জন্য, বেশি ভাবার
অবসরই পায়নি অঞ্জন।
বড়জোর পিয়ালিকে বলা অজন্তার কথাটা মনে করে ফেলেছে
দীর্ঘশ্বাস।
একটা কথা মেনে নেওয়াই ভাল। নষ্ট হয়ে যায় যে
ভাবমূর্তি, তাকে ফিরে পেতে তাড়াহুড়ো বাড়িয়ে চলে নষ্টতার মাত্রাই। বরং ছেড়ে দেওয়া
ভাল সময়ের হাতে। যন্ত্রণা হলেও। উপশম নেই বুঝলেও। মাঝেমধ্যে বাইশ গজের এপাশে
দাঁড়িয়ে দেখতে হয় অন্যপ্রান্তে সঙ্গীদের আসা আর যাওয়া। খেলার নিয়মে সুযোগ থাকে না
ভরাডুবি ঠেকাতে বুক চিতিয়ে তক্ষুনি ওপাশে ছুটে যাওয়ার। নিয়মের বাইরে গণ্ডী ছেড়ে বেরোলেই
তখন ফিরতে হয় সাজঘরে। জীবনের খেলাতেও রয়ে যায় অমন অনেক অদৃশ্য বাইশ গজ। আর সেই
খেলা যে চলবে কত অনন্তকাল ধরে, কে জানে! এসব মুহূর্তে অনুভব করা যায়, মানুষ
নিতান্তই পরিস্থিতির দাস।
এভাবেই কেটে যাচ্ছিল উৎসবের পরবর্তী দিনগুলোও।
আচমকাই ঘটল ঘটনাটা।
উপহারে পাওয়া ফুলদানিটার জন্য একরাশ ফুল কিনে ইছামতীকে
মোটর সাইকেলের পেছনে বসিয়ে ফিরছিল রবার্টসন রোড ধরে।
মিনার্ভা ব্যায়াম সমিতি পেরিয়েছে।
ঋষি বঙ্কিম চ্যাটার্জি রোডে ওঠার ভাল একটা রাস্তা
হয়েছে হালে পৌরসভার দৌলতে।
অনেকদিনের কথা। রেললাইন সংলগ্ন হিন্দুস্থানি
বস্তি থেকে বেরিয়ে আসা একটা অপরিসর নালা কিছুদূর এগিয়ে ক্রমশ চওড়া হয়ে চেহারা নিত বড়
নর্দমার। ঋষি
বঙ্কিম চ্যাটার্জি রোডের তলা দিয়ে পশ্চিমে ঢুকে এসে খালে পরিণত হয়ে বিভাজনরেখার
কাজ করত জলধারাটা উত্তরে ভূতবাগান আর দক্ষিণে মিত্রপাড়ার মধ্যে। আরও এগিয়ে আড়াআড়ি রবার্টসন
রোডের তলা দিয়ে নাকবরাবর পশ্চিমে চলে অতঃপর থানার পাঁচিল ঘেঁষে খালটা মিশত গঙ্গায়।
মিনার্ভা ব্যায়াম সমিতির কাছাকাছি প্রস্থে বা গভীরতায় সর্বোত্তম ছিল নাকি খালটা,
বলা যায় না। তবে মুখে মুখে রটে গিয়েছিল মিনার্ভা খাল নামটাই।
পৌরসভার তরফে কয়েক বছর ধরেই কাজ চলছিল খোলা নর্দমাগুলো
ঢেকে দেওয়ার।
থানার লাগোয়া কিছু অংশ ছেড়ে সিমেন্টের ঢালাইতে চাপা পড়ল মিনার্ভা খালও। পরিণামে
ভূতবাগান ও মিত্রপাড়ার সীমানা ধরে রবার্টসন রোড থেকে সোজা ঋষি বঙ্কিম চ্যাটার্জি
রোডে ওঠার পথও বেরিয়ে এল আচমকাই।
ডানহাতে ঘুরে সেই পথটাই নিয়েছিল অঞ্জন। চওড়া থেকে
বাঁক ঘুরে ঘুরে ক্রমেই সরু হচ্ছিল গলিটা। হঠাৎ বহুদিন ধরে মগজে জমে থাকা আবছা একটা
ছবিকে সামনে ফুটে উঠতে দেখে ঘ্যাঁচ করে ডানপায়ে চাপ দেয় সে।
গাড়ির জাড্যে যত অভ্যস্ত থাকে চালকের শরীর, তত সাবলীলতা
আসে না পেছনের আরোহীর। একদিকে পা ঝুলিয়ে বসলে তো কথাই নেই। খানিকটা ঝাঁকুনি নিজের শরীরেই
টের পেয়েছিল অঞ্জন। ঝাঁঝিয়ে ওঠে ইছামতী, এভাবে থামায় কেউ? পড়ে যাচ্ছিলাম তো
এক্ষুনি। ফাঁকাই তো আছে
রাস্তা...
চাবি ঘুরিয়ে ততক্ষণে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়েছে
অঞ্জন। ইছামতীর কথায় হুঁশ ছিল না তার। সন্ধ্যার জমাট বাঁধা অন্ধকারের পটভূমিতে
আশপাশের বাড়ি থেকে ছিটকে আসা আলোর মিশেল ঘটে তখন চিকচিক করছে সামনের পথটুকু।
ইছামতী শুনতে পায় অস্ফুটে উচ্চারণ করছে অঞ্জন, সুকান্তর
গলি...
কী ছিল সেই উচ্চারণে! আর বিরক্ত হতে পারে না
ইছামতী। তার নিজের কাছে মূল্য থাক আর না-ই থাক, এত বছর পর একটা মানুষের খুঁজে
পাওয়াকে বিব্রত করে কী লাভ! ততক্ষণে রাস্তায় নেমে দাঁড়িয়েছে দু’জনেই। সুর নামিয়ে
বলে ইছামতী, এই সেই রাস্তা? এত কাছেই ছিল?
অবিকল সেই বাড়িঘর। আঁকা হয়ে থেকে গিয়েছিল ঠিক
যেমনটা এত বছর ধরে...
সুকান্তরা কোন বাড়িটায় থাকত?
সুকান্তরা এখানে থাকত না কোনওদিনই...
হোঁচট লাগে ইছামতীর, তাহলে! এই যে বললে সুকান্তর
গলি!
সুকান্তর গলিই অবিকল। কিন্তু এখানে আসিনি সেদিন। গলিটাই
যে ছিল না। পায়ের তলায় এই মুহূর্তে মিনার্ভা খাল। সেদিন ঢাকা পড়েনি খালটা। এই
রাস্তাও ছিল না তাই।
কী বলবে ভেবে পায় না ইছামতী। তখন অল্প অল্প হাওয়া
বইছে গলিতে। সেই
হাওয়াকে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু করা যায় অনুভব। যেভাবে দেখা যায় না পায়ের তলা দিয়ে
মিনার্ভা খালের বয়ে যাওয়া। এসবই ভাবছিল ইছামতী। মুখের রেখায়, চোখের তারায় ফুটে
উঠেছিল নাকি তার মনের ভাব, টের পায়নি। বা ফুটে উঠলেও সেদিকে মোটেই খেয়াল ছিল না
অঞ্জনের। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল সে গলিটাকে। দেখতে দেখতেই কখন যে হয়ে উঠেছিল
অন্তর্যামী, বুঝতেই পারেনি ইছামতী। পারিপার্শ্বিক আলো-আঁধারির মিশেলে, গলির ভেতর
পাক খেয়ে চলা সেই অল্প অল্প হাওয়ায় এবার শোঁ শোঁ করে ওঠে অঞ্জনের গলা, আজ আর দেখা যাবে
না মিনার্ভা খালের বয়ে চলা। কিন্তু চাপা পড়ে গিয়েই সে তৈরি করে দিয়ে গেল গলিটাকে।
কিন্তু এ কেমন খুঁজে পাওয়া? একজনের অস্তিত্বের মূল্যে!
বাস্তবের গলিটাতেও তো পৌঁছনো হল না...
নিজের গলা নিজের কানেই কেমন ফ্যাসফ্যাসে অচেনা
শোনাল ইছামতীর। বুঝতে পারল না, এ কথা কি সে-ই বলল নাকি বলিয়ে নিল কবে থেকে
মিনার্ভা খালে বসবাস করা কোনও অশরীরী! এমন কথা তার মতো পরিণত বুদ্ধির মানুষের
চিন্তায় আসতে পারে, তাও তো ভাবেনি কোনওদিন।
সেই শোঁ শোঁ শব্দেই বলে চলে অঞ্জন, তার দরকারও
নেই। বেশ নিশ্চিন্ত লাগছে আজ। আর লাগছে বলেই বুঝতে পারছি আসলে সুকান্তর গলিটাকে
কোনওদিনই খুঁজিনি আমি। খুঁজে এসেছি মাথার মধ্যে রয়ে যাওয়া সেই ছবিটাকে। যে কোনও
জায়গাতেই খুঁজে পাওয়া যেত তাকে। কিন্তু শর্তও ছিল একটা।
কী শর্ত?
মিনার্ভা খালের হারিয়ে যাওয়া। সে হারিয়ে গিয়েই বানিয়ে
গেছে ছবিটা। একটা সম্পর্কের শবদেহের ওপর যেভাবে নির্মিত হয়ে ওঠে আর-একটা নতুন
সম্পর্ক। তেমনই এই খালের
হারিয়ে যাওয়া, সুকান্তর গলির মূল্যে...
সুকান্তর গলির আলো-আঁধারিতে চোখ নামিয়ে নেয়
ইছামতী।
No comments:
Post a Comment