সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়

বাক্‌ ১৪১ ।। তপোভাগ— ১২ শ পর্ব




পুড়তে থাকা সময়খণ্ড

যমুনাপারে নাগপল্লীতে অশান্তি লেগে গেছে। কয়েকদিন আগে থেকে মানুষ মরতে শুরু করেছে। এমনিতেই এটি নিছক ছোটো একটি পল্লী, মথুরার নিকটে কিন্তু সংলগ্ন নয়। মধ্যে যমুনা। নাগবসতি যমুনার গা ঘেঁষেও নয়, একটু দূরে, বরং বনের দিকে। মানুষের হাত ও পা মিলিয়ে যতোগুলি আঙ্গুল হয়, অনুমান ততোদিন আগে এক নাগযুবক এই পল্লীতে এসেছিলো। আসলে ফিরে এসেছিলো। পূর্বদেশের রোমাঞ্চকর কাহিনী শুনিয়েছিলো সে, অপূর্ব মদ্য, রঙ্গিনী যুবতী, রক্তিম অরণ্য আর মুক্ত শিকারভূমির গল্প। চাঁদ ওঠা সন্ধেয় তার গল্প শুনতে শুনতে যুবকরা মাতাল হয়, যুবতীরা হয় নৃত্যপরা। গ্রামবৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কয়েকবার তাদের সাবধান করছিলেন, উৎসবের হুল্লোড় শুনে আকাট আরিয়রা তেড়ে আসতে পারে, এই ভয়ে। তারপর তাঁদেরও নিজ নিজ যৌবনকাল মনে পড়ে যায়। যা হবে হবে ভেবে যৌবনকালে, তাঁরাও  তো এভাবে কাটিয়েছেন সময়ে সময়। বেশ রাত অব্দি, ঘন চাঁদ আকাশ থেকে মাদক ঝরিয়েছিলো সে রাতে।
 পরের দিন সকালবেলা, সেই প্রত্যাগত যুবকটি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না, তার কুটিরের ভেতর এক অস্বস্তিকর গন্ধ, হঠাৎ হঠাৎ তার শরীরে তড়কা লাগে, দেখে আতঙ্ক জাগে। এরপর একে একে বাকিদেরও। একে একে একটি গাছ থেকে পাশের গাছে ছড়িয়ে যেতে থাকে দাবানল। যে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বারণ করেছিল আগের রাতে, তারা কপাল চাপড়ে আর্তনাদ করতে শুরু করে। অন্যরা তাদের শীঘ্র চুপ করায়।  তবুও যাদবদের কাছে খবর চলে যায় একদিনের মধ্যে।
পরের দিন সকালে মদোন্মত্ত যাদবরা নদী পেরিয়ে আসে। এসেই বিনা বাক্যব্যয়ে তারা নাগপল্লীর কুটিরগুলি ভাঙতে শুরু করে, যেখানে যা পায়। নাগরা সত্বর পোঁটলাপুঁটলি বেঁধে, শিশুদের সামলে পালাতে শুরু করে। কোনদিকে? কোনো দিক নেই, সব দিশাই বিদিশা। অরণ্য, একমাত্র অরণ্য তারা জানে, তাদের আশ্রয়৷ তারা জানে, এরপর আগুন লাগবে। ভস্মীভূত হয়ে যাবে তাদের আবাস। যে আশ্রয়ে কতো কতো রাত দিন কেটেছে আনন্দবেদনায়, গৃহ হয়ে ওঠা সেই এক একটি আবাস পুড়ে যাবে। পুড়ে যাবে প্রিয় কন্থাটি, যার মধ্যে নিজের গায়ের গন্ধ টের পাওয়া যেতো। পুড়ে যাবে সেই সব সরঞ্জাম, যা দিয়ে স্বল্পতোয়া যমুনার নীল জল থেকে জেদী রূপোলি মৎসকন্যাদের তুলে আনতো তারা। পুড়ে যাবে তাদের আয়ুধ, যা শিকারে কাজে লাগতো, লাগতো অন্যান্য কাজেও।  বহুকাল, বহু বহুকাল এমন ঘটেনি, কিন্তু বহুকালদর্শী বৃদ্ধ বৃদ্ধারা এসবের কথা শুনিয়েছে তাদের। আজ সেই গল্পকথা জ্যান্ত হয়ে উঠলো। হ্যাঁ, এবার পুড়ে যাবে নিটোল একটি সময়খণ্ড।
ধোঁয়ানো ছাইগাদার ওপর শিশির পড়বে রাতে। ধোঁয়া একসময় থেমে যাবে। শিশির পড়বে আবার। পড়তে থাকবে। ছড়িয়ে যাবে ভস্মরাশি৷ বৃষ্টি পড়বে। জল এক সাধারণীপ্রবণ সত্তা, সে সব সমান করে দিতে চায়। পরে, কোন একদিন, ছাইগাদা থেকে বেরোবে অঙ্কুর, ভস্মরাশির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে সবুজ পাতা।
এখন যারা আছে, কেউ থাকবে, কেউ থাকবেনা৷ কিছু ঘাস শুকিয়ে যাবে, কিছু পাতা পুড়ে যাবে। কিন্তু কিছু থেমে থাকবেনা৷
 
                                               

ঋতুউত্তীর্ণা রমণীর প্রণয় এইই শেষবার, আর কখনো গ্রহণ করবেন না অক্রুর। নিজেকে নির্যাতন করার এমন উপায় আর হয় না। পাপ, পাপ! কেন যে এ পাপ করেছিলেন! মাঝে মাঝে আপন মস্তকটি প্রস্তরপট্টে বিদীর্ণ করতে ইচ্ছে করে সেই ভুলের কথা মনে পড়লেই। উঃ এক ভুলের জন্য কি এতকাল, এত এতকাল ধরে শাস্তি পেতে হয়?
 নাগপল্লীতে মড়ক ছড়িয়েছে। এ কোনো চেনা পীড়া নয়। এর লক্ষণগুলি অতি সাধারণ কিন্তু পীড়ার ঠিক সেই স্তর, যেখান থেকে ধীরে ধীরে মানুষ সুস্থ হয়ে উঠতে আরম্ভ করে, সেইখান থেকে এই পীড়ায় অদ্ভূত অন্যরকম হচ্ছে এবার। পটাপট মরছে লোকে। নাগবসতি উঠিয়ে দেবার জন্য যে সেনাদের পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যেও অনেকে ফেরার একদিনের মধ্যেই পীড়াগ্রস্ত হয়েছে, এখনো কেউ মরেনি, তবে ভরসা করাও যাচ্ছেনা। সেনারা স্বতন্ত্র আবাসে থাকে, সেখানেই তাদের থাকতে বলা হয়েছে। নগরময় অরাজকতা। এই ক্রান্তিকালে চৌর ও তঞ্চকদের সুবিধা হয়েছে। রমণীরা পথে বেরোচ্ছেন কম, মথুরানগরীর সাতটি বিখ্যাত রথ্যায় নারীচলাচল দেখাই যাচ্ছেনা, পথে রথই নেই, কদাচিৎ এক আধটি গো শকট। সাধারণ যে কোনো নাগরিক সশস্ত্র না হয়ে পথে বেরোচ্ছেন না। সংঘমুখ্যদের নিয়ে নৃপতি কয়েকবার জরুরী মন্ত্রণা করেছেন, তাতে কি স্থির করা হয়েছে তা নিয়ে বিবিধ জনশ্রুতি উড়ছে। শৌণ্ডিকালয়ে অবশ্য মাছি তাড়াতে হচ্ছেনা, রসপায়ীরা সেখানে সাধ্যমতো গতায়াত করছে, তবে সংখ্যায় অনেক, অনেক কম।
এমত অবস্থায়ও যদি কারোর প্রচুর প্রণয় জেগে ওঠে, তবে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে হয়!
কেউ বলছে ইন্দ্রযজ্ঞ হবে, নৃপতি আদেশ দিয়েছেন। কেউ বলছে না, ইন্দ্রযজ্ঞ হলে তো বৃষ্টি হবে, বৃষ্টি হলে আরো বেশি সমস্যা। ইন্দ্রযজ্ঞ না রুদ্রাভিষেক হবে। কেউ বলছে হতভাগা নাগদের সদলবলে যমালয়ে প্রেরণ করলেই তো হয়, অশান্তির উৎস তো তারাই। তখন মনে পড়ছে, যারা গেছিলো নাগদের তাড়াতে, যে কোনো কারণেই হোক, তারা শেষ পর্যন্ত সে পল্লীতে আগুণ দেয়নি, ফিরে এসেছে। নাগরা কি প্রেত পোষে? সে পল্লীতে নাকি এক অশরীরী আবহাওয়া দেখে সেনারা থমকে যায়, ফিরে আসে, পরে তাদের মধ্যে অনেকেই অসুস্থ হয়েছে। কেউ বলছে রাজ আদেশে শুদ্ধাচারী তিন ব্রাহ্মণকে নিয়ে রথ গেছে পশ্চিমে, সরস্বতী নদীর পবিত্র উদক নিয়ে আসতে!
সরস্বতী, সরস্বতী! মাতা সরসবতী শীর্ণা হয়েছেন, তারপরও দেশে মড়ক লাগবেনা? দ্বাদশ বর্ষব্যাপী সেই শুষ্কতা। সরস্বতীর অঙ্গ শীর্ণ হয়ে গ্যালো, স্থানে স্থানে স্ফোটকের মতো গজিয়ে উঠলো নদীচর। ক্রমে ক্রমে সেই নদীচর বড়ো হতে হতে গ্রাস করে নিলো প্রাণদায়ী জলধারার স্থানিকতা। একবার দেব শেষনাগও মস্তক নেড়েছিলেন বলে জানা যায়, সেই দ্বাদশ বর্ষের আগে। তারপরই দেবী সরস্বতী যেন এই ধারা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলেন। পিতৃপিতামহদের কথায় এখনো সরস্বতীর গান, তাঁদের মধ্যে স্বচক্ষে সেই যৌবনবতী ধারা দেখেছেন, এমন বিশেষ কেউ নেই। সবারই শোনা কথা। তবু সেই অস্তাচলগামী নদীতে বিলুপ্তপ্রায় শীর্ণা এক ধারা রয়েছে, সেই ধারা থেকে পবিত্র উদক আনতে চলেছেন বিপ্রত্রয়।

                                              
নাগরা পালায়। প্রিয় বসতি থেকে, প্রিয় যমুনা থেকে, প্রাণময় অরণ্যের মধ্যে দিয়ে পালায়। কেউ কেউ পারেনা। কেউ কেউ পড়ে থাকে অন্নহীন ভরসাহীন পরিত্যক্ত বসতিতে, তাদের কোথাও যাবার সংগতি নেই। অসহায় পড়ে থেকে তারা মৃত্যুর করুণার ওপর নির্ভর করে থাকে। যদি মৃত্যু তাদের করুণা করে অব্যাহতি দেয়, এ ছাড়া তাদের হাতে আর কোনো উপায় নেই। প্রথমে পীড়ার সূচনায় তারা আঁতকে উঠেছিলো, পরে যাদবদের আক্রমণে তারা ধরে নিয়েছিলো যে পীড়ায় না মরলে যাদব মারবে। উপস্থিত যাদব প্রহার থেকে বাঁচতে তারা পালাতে শুরু করেছিলো। মথুরার সেনারা গ্রামে আগুন না দিয়ে ফিরে গেলে অরণ্যের আড়াল থেকে গুটি গুটি বেরিয়ে আসে দুয়েকজন। চলে যেতে মন চায় না। যাদবসেনারা আপাতত ঘাঁটাতে আসবেওনা। কিন্তু পল্লীতে পীড়ার প্রকোপ এবং খাদ্যাভাব। সমর্থ যারা, তারা পোঁটলা বেঁধে বাচ্চাদের কোলেকাঁখে নিয়ে অরণ্যের ভেতর দিয়ে চলে যায়। অরণ্যমধ্যের স্বাভাবিক জলাশয়ে জল খায়, বনে কন্দ খুঁজে খায়, ফল। আরণ্যপশুরা দূর দিয়ে যায়, সমবেত মনুষ্যমণ্ডলীকে তারা এড়িয়ে চলে। শুধু বন্য সারমেয়রা লোলুপ। সারি দিয়ে নাগযূথ চলে। সারির শেষভাগে যদি কোন শিশু একলা পড়ে যায়, বন্য সারমেয়দল তার অপেক্ষায় থাকে। অরণ্যর ফাঁক দিয়ে গ্রাম জনপদ দেখা গেলে নাগরা সাবধান হয়, আরো দূর দিয়ে যায়৷ গ্রামবাসীরা নিজেদের সুরক্ষার জন্যই তাদের আক্রমণ করতে পারে। কোনো জনপদে গিয়ে ওঠা যাবেনা, তারাও খেদাবে। অরণ্যমধ্যস্থ কোনো জলাশয়সমন্বিত ভূভাগ খুঁজতে খুঁজতে চলে। গ্রামবৃদ্ধ বৃদ্ধাদের তারা আনতে পারেনি, তাদের জন্য চোখের জল ফেলতে ফেলতে চলে নাগরা, জল ঝরে পোষ্যগুলির জন্য, নাগপল্লীটির জন্য, মথুরা যমুনার জন্য।
পথিমধ্যে পড়ে মরে কেউ। পীড়াটি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো হয়তো সে। তার থেকেও জরুরী, খাদ্যাভাব। অরণ্যের মধ্যে কন্দ ফলমূল খুঁজে যা পাওয়া যায়, তাতে সকলের কুলোয় না। যে আগে খুঁজে পায়, সে নিজের পুত্রকলত্রকে আগে দেয়। যে পায়না, সে না পেতে পেতে গিয়ে মরে যায়। যূথ থামেনা। থামবার উপায় নেই। পথিমধ্যে মৃত্যু থাকতে পারে, তাকে পাশ কাটিয়েও বেঁচে যাওয়া যেতে পারে। থামলে মৃত্যুকে এড়ানোর উপায় নেই এই দুঃসময়ে। ক্লান্ত শিশুরা হাঁটতে না পেরে পিতার কাঁধে মাতার কোলে চেপে যায়। সে পিতা আর মাতা তাদের নিয়ে চলতে থাকে, যতোক্ষণ না পড়ে যায়। মৃত্যুর মুখ থেকে নিজেদের ছিনিয়ে নিতে নিতে চলে জীবন।
হয়ত তারা খুঁজে পাবে কোনো জলাশয়সমন্বিত সরস ভূভাগ। 

                                  
শৌণ্ডিকালয়ে দুয়েকটি রসবান মৃদুমন্থর গতিতে আলোচনা করছে। যদি সেই পাষণ্ড জরাসন্ধ এখন মথুরা আক্রমণ করে, কি হবে? এই বিপন্ন ও বিশৃঙ্খল অবস্থায় মথুরানগরী তো সহজেই বিজিত হবে। নগরীর বাইরে নাগবাসতির স্বাভাবিক প্রাচীরও তো এখন ধ্বস্ত। কিন্তু সে জরাসন্ধ কি আর অতোই মূর্খ? মথুরা জয় করতে এসে বিজয়মাল্যর পরিবর্তে পীড়ার সংক্রমণ নিতে চাইবে না নিশ্চয়ই। শৌণ্ডিক এই অবসরে কলসপ্রতি পানীয়র মূল্য নিচ্ছে অধিক, ভর্জিত মৎস্যান্ড কুক্কুটাণ্ডও হঠাৎ অধিক মূল্য ধারণ করছে। শৌণ্ডিককে গালি দিচ্ছে তাঁরা, কিন্তু উপায়ও নেই, রক্ষী দূর্লভ পথে, পরিষদে অভিযোগ জানানো এখন সমস্যার, পরিষদ অন্যবিধ নানা কারণে ব্যস্ত। সবচেয়ে বড়ো কথা এই দূর্দিনে প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাওয়া যা যাচ্ছে, এই ঢের!
ভয়ের এক আবহ চেপে বসেছে নগরীতে। হট্ট বিপণী বন্ধ, কেউ কোত্থাও নেই, প্রাক বসন্তের এই হাওয়ায় এলোমেলো পাতা ঝরে পড়ছে, সমস্ত মথুরাপুরী যেন এক পরিত্যক্ত নগরী। অথচ যে কোনো গৃহের দ্বারের পশ্চাতে মানুষ রয়েছে, ভয়ে। দুয়েকজন স্বভাবতঃই সাহসী মানুষ, তাদের ধারণা তাদের কিছু হবেনা, প্রকাশ্য রাজবর্ত্মে না হোক, রথ্যায় না হোক, গলিপথে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যদি কাউকে পাওয়া যায়। না, কোনো প্রয়োজন নয়, এমনিই। আসলে মানুষজনের সঙ্গে অকাজের কথাবার্তা বলতে না পারলে তাঁদের পেট ফোলে। শুন্যপ্রায় নগরীতে ঘুরে ঘুরে তাঁরা মানুষ খুঁজছেন। হট্টবিপণীগুলি বন্ধ, কারণ প্রান্তস্থ গ্রামগুলি থেকে গো শকট আসছেনা। তারা জেনে গেছে মথুরানগরে কালান্তক মড়ক ছড়িয়েছে, সাধ করে কেউ সে মৃত্যুর মুখে যেতে চায়? খাদ্যের ভাণ্ডারে এখনো টান পড়েনি, কিন্তু পক্ষকালের মধ্যে কোনো ব্যবস্থা না হলে টান পড়বে। মথুরানগরে এত এত মানুষ, এত এত পেট, সঞ্চিত ভাণ্ডারে কয়দিন চলবে? ধৈর্য ধরে মারীর প্রকোপ কমে যাওয়ার অপেক্ষা করতে হলেও পেটে খাদ্য চাই। খাদ্য নইলে প্রাণশক্তি নিভু নিভু হয়ে আসে, প্রাণপাখি কন্ঠাগ্রে এসে বেরোবার পথ খুঁজতে থাকেন এমনিতেই। খুব বেশি হলে এক পক্ষ। তার পর আর চালানো যাবেনা। খাদ্যের যোগানের ব্যবস্থা করতে হবেই।
  অক্রুর একদম প্রথমেই কিকরে যেন আঁচ পেয়েছিলেন খাদ্যসমস্যা হবে। প্রথমেই তিনি বাড়ির লোকেদের পাঠিয়ে দেন বিদর্ভে। বৃষ্ণিকূলের দুইভাই, প্রসেন ও সত্রাজিৎও তাই করছিলেন, অক্রুরও বৃষ্ণিবংশীয়, তুতো ভাই, একই সাথে নিজের বাড়ির লোকেদের পাঠিয়ে দেন বিদর্ভে, নরপতি  ভীষ্মকের রাজ্যে। নগরীর উত্তর পশ্চিমে বৃষ্ণিবংশীয় দুইভাই প্রসেন ও সত্রাজিৎ একসাথেই থাকেন৷ প্রসেন একটু সরলসোজা মানুষ, হঠাৎ আসা এই আপৎকালে বিচলিত হয়ে পড়েছেন৷ কখনো তিনি চাইছেন উগ্রসেনের কাছে ছুটে গিয়ে মন্ত্রণা দিতে। কখনো চাইছেন লগুড়হস্তে গিয়ে নাগপল্লীটি চুরমার করে আসতে। বাটিকাসংলগ্ন সুবিশাল গৃহে তিনি কোথাও একদণ্ড সুস্থির হয়ে অবস্থান করছেন না। সত্রাজিৎ তুলনায় শান্ত কিন্তু অধিক সাবধানী। খুব জরুরী প্রয়োজন না থাকলে আর নরপতি নিজে না ডাকলে সেখানে যে যেতে নেই, সেকথা অগ্রজকে বোঝাচ্ছেন। অক্রুরকে তাঁরা তাদের আলয়ে থাকতে আহ্বান করেছিলেন, অক্রুর সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। নিজের গৃহটি তাকে নিজেকে পাহারা দিতে হবে এই অসময়ে। হ্যাঁ, নিজস্ব পারিবারিক রক্ষীদল রয়েছে, গৃহে অন্য রক্তসম্পর্কের আত্মীয়ও রয়েছে যাঁরা অন্নদাস বলে যথেষ্ট কাজে লাগে। তাদের হাতে গৃহের সুরক্ষা ছেড়ে রাখা এই আপৎকালে কোনো কাজের কথা নয়। অক্রুর কতিপয় স্থলিকা চিপিটক, বেশ কয়েক কলস গুড়, কয়েক দ্রোণ মধু আগেই সঞ্চয় করে নিয়েছিলেন। বাকিদের বিদর্ভে পাঠিয়ে দিয়ে যে কয়জন তাঁরা রয়েছেন, তাদের বাকি সম্ভার শেষ হতে মাসান্ত, তার আগে এই চিপিটক গুড় ও মধুতে হাত দেবার প্রয়োজন হবেনা। সারা মথুরানগরী রিক্ত হয়ে গেলেও অক্রুরের খাদ্যাভাব হবেনা। দেখা যাক ইতিমধ্যে নৃপতি কি ব্যবস্থা করেন, সংঘমুখ্যরাই বা কি নির্ধারণ করেন, ইন্দ্রযজ্ঞ রুদ্রাভিষেকে কদ্দুর কি কাজ হয়।
দিনে দিনে যেমন তেমন, সন্ধ্যাবেলায় এ মথুরানগরীকে দেখে চেনা যাচ্ছেনা। এ কি সেই নগরী? যদু বৃষ্ণি সাত্বত হৈহয় অন্ধক কুকুর ভোজবংশীয়দের লীলাস্থল, ভারতভূমির অন্য সকল নগরীর ঈর্ষোদ্রেককারী নগরী এই সে? গৃহে গৃহে মঙ্গলদীপ যেন স্তিমিত, শিশুরা হঠাৎ বড়োদের অস্বাভাবিক আচরণ দেখে স্তম্ভিত হয়ে আছে, কলহাস্যময়ী যুবতীরা পর্যন্ত অকারণে হাস্যমুখর হয়ে ওঠা সম্বরণ করে রেখেছে। যমুনা নদীর জলই এই সমস্ত নগরীর প্রানরস বলা যায়, সেই যমুনার জলও এখন বিষবৎ পরিত্যাগ করেছে নগরবাসী। যার গৃহে কূপ আছে, তার তবু স্নানপানের জলের ব্যবস্থা হয়ে যায়। যার বাটিকায় জলাশয় আছে, সেখান থেকে প্রতিবেশীরা প্রয়োজনীয় জল নিয়ে যাচ্ছে, তবে কাউকে তার কলস সরসীতে ডোবাতে দিচ্ছেনা রক্ষীরা। পৃথক কলসে করে তুলে আলগোছে ঢেলে দিচ্ছে। সংঘমুখ্যরা আপন আপন গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখছেন। দূত চালাচালি এ মুহূর্তে বেড়ে গেছে খুব। পথে মানুষজন নেই, কদাচিৎ কোনো রক্ষীকে দেখা যাচ্ছে দূত ছাড়া। পথকুক্কুরগুলি গৃহস্থের ও মদ্যপের উদ্বৃত্ত খাদ্যের ভরসায় বাঁচে, এ অকালে তারা প্রত্যেকেই ঝুঁকি নিয়ে খাদ্যের সন্ধানে আপন অঞ্চলের বাইরে গিয়ে সেখানকার ক্ষুধার্ত কুকুরদের কাছে মার খেয়ে ফিরছে। পাখি ডাকাডাকি বেড়ে গেছে হঠাৎ। মথুরানগরীর স্বাভাবিক জনচলাচল হৈ হট্টগোলে তারা অভ্যস্ত, তার অন্যথা দেখে তারা কি একটু বিস্মিত? হয়তো! হ্যাঁ তাদের এ ডাকাডাকিও যে স্বাভাবিক নয়, এটুকুও বুঝতে পারা যায়। এক আকূলতা, এক বিপন্ন বিস্ময় ফুটে উঠছে তাদের স্বরে!
                           
                                 
শুধু এক সুগন্ধী বালিকা মথুরানগরীতে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন বা নগরলক্ষী, পল্লীতে পল্লীতে চরনমঞ্জীর বাজিয়ে সকল নগরবাসীকে প্রসাদ দান করছে সে। যে স্থান দিয়ে সে পার হয়, সুগন্ধী বাতাস সেই স্থানে অনেকক্ষণ ভেসে থাকে। যে বয়েসের বালিকাকে দেখে তার পিতামাতা চিন্তিত হয়ে ওঠেন না, এ সে বয়েসের বালিকা। ঋতুমতী হতে এখনো দেরি আছে তার। প্রমাণ আকৃতির কোনো মানুষের কটিদেশ অব্দি সদ্য পৌঁছেছে তার মাথার উচ্চতা। বেশবাস গোছানো। সৌরভময়। ফুল তোলার মতো ছন্দে সে নগরীময় নেচে নেচে বেড়াচ্ছে যেন। পথকুক্কুরগুলি তার বন্ধু, তাকে দেখেই লেজ নাড়ে, তারপর তার পিছু পিছু যায় নিজের এলাকা পর্যন্ত। সেখান থেকে পরের এলাকার কুকুরগুলি তার সঙ্গ নেয়। পাখিরা তার মাথার আশেপাশে ওড়ে, নির্ভয়ে। নগরীর সব কাননে তার অবাধ গতি। যে কোনো কাননে সে গিয়ে পুষ্পচয়ন করতে পারে, কেউ তাকে কিছু বলে না, আর এখন তো বলবার মতো কেউ নেই। চম্পককলির মতো অলৌকিক অঙ্গুলিগুলি দিয়ে সে অল্প ফুল ছোঁয়। বাপমা কেউ নেই তার। যখন যেখানে পারে থাকে, যখন যেখানে পারে খায়। রাজদ্বারেও তার অবাধ গতি কিন্তু সেখানে যেতে তার ভালো লাগে না। বাকি সারা নগরীই যেমন তার খেলার স্থল, রাজবাড়িতে ঠিক তেমন পায়না সে। রক্ষীরা তাকে কিছু বলেনা, কিন্তু তাদের গম্ভীর মুখ আর পাকানো গুম্ফ দেখে তার উৎসাহ থাকেনা। রাজবাড়ি সে তাই এড়িয়ে চলে।
  আর সে যায়না যমুনাপারে। একবার পা ফস্কে জলে গিয়ে পড়েছিলো সে, সেই থেকে যমুনাকে তার ভয়, যমুনা থেকে সে দূরত্ব রাখে। সেবার ডুবেই যেতো, কিয়দ্দুরে এক স্নানার্থী স্নান করছিলো, তাকে জলে ডুবে যেতে দেখে দ্রুত এসে বাঁচায়। সবাই সাঁতার জানে এখানে, শুধু সে জানেনা সাঁতার, তার সাঁতার দেবার উপায় নেই।
বড়ো মিষ্ট মুখশ্রী এই বালিকার। নগরলক্ষী হবার উপযুক্ত শ্রী, আহা! অপার বিস্ময়মাখা দীঘির মতো টলটলে দুটি চোখ, উচ্চ নাসা, রক্তিম ঠোঁটদুটি  সর্বদাই বিড়বিড় করে কি যেন বলছে, অস্ফূটে, বুঝি নিজের সঙ্গে সর্বদা কথা বলছে বালিকা। অথবা যেন বা সে মায়ালোকে আছে, দেব গন্ধর্বরা তার খেলার সাথী, সর্বদাই তার সঙ্গে তাঁরা গল্প করছেন, তাঁদের শুধু সে দেখতে পায়, আর কেউ পায় না। শৈশবলালিত্যময় এই সুমিষ্ট বালিকার কোনো একদিন যৌবন আসবে, দেব কন্দর্প বালিকার বুকে এঁকে দেবেন দুটি ঢেউ। সে নারী হয়ে উঠবে, কিন্তু তার এখনো দেরী আছে।
কন্দর্পের দান সেই ঢেউদুটি তার শরীরে আসতে দেরি আছে, কিন্তু অন্য তিনটি অবাঞ্ছিত ঢেউ শরীরে নিয়ে সে জন্মেছে। তিনটি কুঁজ। নগরীর লোকেরা তাকে কুব্জা বলে ডাকে।

No comments:

Post a Comment