অভিরূপ মিত্র

বাক্‌ ১৪১ ।। চাডিকুটাম



আবহাওয়াটা থুম মেরে আছে। বৃষ্টি হতে পারে পারে ভাব, কিন্তু হচ্ছে না। বাতাসে জলকণা বাড়ছে। বাড়ছে অস্বস্তিসূচক। ব্যাপারটা তো এমন নয় যে গ্রীষ্মকালের নামে অ্যালট করা প্রথম মাসটার পাতার প্রয়োজন ফুরল, সেটা রুদ্রাণী ছিঁড়ে ফেলে দিল আর ধীরে ধীরে বর্ষার বিভিন্ন কারণ প্রস্তুতি নেওয়ার উদ্যোগ নিল গাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গের আকাশ জুড়ে।
          “তোমাকে বলেছি না অনেকবার, ওইভাবে পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে দেবে না?”
          স্নানঘর থেকে বেরিয়ে ইন্দিবর গামছা পরেই নিয়মমাফিক পেন্নাম ঠুকে বিরক্তি প্রকাশ করল।
          একটু ডিঙি মেরে পিছন থেকে থুঁতনি বসানো যায় চওড়া কাঁধের পেশল পাটাতনে। ওভাবে ছবি আছে একটাবেদান্ত তুলে দিয়েছিল
          “মনে হচ্ছে ইন্দুদার কানের পাশে চাঁদ উঠেছে!”
          ছবিটা দেখে বলেছিল ইন্দ্রাণীতখন ছবি তোলামাত্রই বাজারি হয়ে যেত না। পছন্দ, ভালোবাসার চিহ্ন অথবা রাগের অভিব্যক্তি বা একফোঁটা অশ্রুর শোক ছেয়ে ফেলত না ব্যক্তিগত মুহূর্তরুদ্রাণী তখনও অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা পায়নি বরের কাছ থেকেতখনও ছবি তোলা হত ক্যামেরায়, সাঁটা হত অ্যালবামে
          ধূপকাঠির আগুনটা বাতাসে ধোঁয়ার কুণ্ডলী রেখে ঢুকে গেল শোবার ঘরে। এ সময় ছোঁয়া নিষেধ। স্নান না করা শরীর নিয়ে গেলে অশুচি হয়ে যেতে পারে ইন্দিবরের মন।
          এ বছর দিনটা আবার জ্যৈষ্ঠ মাসে পড়েছে, গত বছর আষাঢ়ে ছিল। বাংলা ক্যালেন্ডারের দিনগুলোর নীচে, ফাঁকা জায়গায়, কখনও সংখ্যার পরিবর্তে অনেককিছু লেখা থাকে। ইন্দিবর দেখে, নিয়মকানুন মেনে চলতে সুবিধে হয়। কখনও-কখনও পুরনো দিন, কবে কী ব্রত ছিল, জানা-দেখা দরকার হতেই পারে। ছিঁড়ে ফেলে ভুল করেছে রুদ্রাণীইন্দিবরের অসুবিধা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
          টেবিলে খাবার বাড়তে বাড়তে মনে হয়, এক কোয়া রসুনটার খোসাগুলো উড়ে যাচ্ছে এদিক-ওদিক। চিন্তাগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। রাতেও গন্ধ পায় মুখে। ঘন হয়ে এলে, নিয়মমাফিক, সময়মতো।
          গিঁট খোলার পরই রুদ্রাণী বলেছিল একদিন, “এখন না
“কেন?” বিস্মিত হয়েছিল ইন্দিবর।
“না, আজকে আর না। আজ শুধু গল্প করব
“এখন গল্প?” যান্ত্রিক বিস্ময় মনে হয়েছিল কি? তবু রুদ্রাণী জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল
“বাবা বলত সময়ের কাজ সময়ে করবি। ঘড়ি ধরে” ইন্দিবরের মুখে চাপা হাসি।
“বাবা বুঝি এখন আর বলেন না?” দুষ্টু হাসি রুদ্রাণীর চোখে।
হাসি মিলিয়ে যায় ইন্দিবরের, “নিয়মিত খবর রাখলেও কথা হয় কতটুকু?”
“যাও না কেন ঘন ঘন? বাবার সঙ্গে কথা বললেই তো পারো
রুদ্রাণীর কণ্ঠস্বরকে অনুভূতির চেনা লিটমাসে ঠিক ধরতে পারছে না ইন্দিবর। বলে, “যখনতখন গেলে বাবার না-ই ভালো লাগতে পারে
“ও মা, সে কী কথা? ছেলে যাবে বাবার কাছে তাতে আবার খারাপ লাগার কী আছে?”
ইন্দিবর চুপ করে থাকে। কিছু বলে না। রুদ্রাণী মৃদু ঠেলা দেয়, “কী হল? বলছ না কিছু’’
“বাবা খুব সময় ধরে কাজ করতে বলত। এক সময়ের কাজ অন্য সময়ে করতে দিত না—’’ ইন্দিবর আবার থেমে যায়। কথা অসমাপ্ত রেখেই। রুদ্রাণী না বলা কথাগুলো ছোঁয়ার চেষ্টা করে। আলতো করে হাত বোলায় বরের কপালে, চুলে। মাথার পেছনে হাত দিয়ে মুখটাকে টেনে আনতে চায় নিজের দিকে। ইন্দিবর চুপ করে থাকে।
          “পাখা চালিয়ে কেন খোসা ছাড়াও?”
          হঠাৎ ঝ্যাঁজকানিতে সংবিৎ ফেরে। রুদ্রাণী সুইচটা অফ করে দেয়।
          “খেতে বসলাম আর পাখাটা বন্ধ করে দিলে?”
          রুদ্রাণী বিভ্রান্ত বোধ করে। একটা রসুন খোসা ছাড়িয়ে ছুরি দিয়ে তার গায়ে গভীর দাগ কেটে কেটে মধুতে চব্বিশ ঘণ্টা ভিজিয়ে না রাখলে পরের দিন খেতে বসেই ইন্দিবর ওটা পাবে কী করে?
বুদ্ধিটা বেদান্তর বোন ইলিনার নিউট্রিশনে এম এসসি। এক কোয়া রসুন নাকি মধুতে ভিজিয়ে খেলে গলিয়ে দেয় সূক্ষ্ম ফ্যাট। ধমনিকা আরও বেশি অক্সিজেন নিয়ে যেতে পারে। সচল হয় স্নায়ুসূত্রে উত্তেজনাপ্রবাহ। তবুও অন্য সময় আর মনে থাকে না রুদ্রাণীর।
          “রসুনটা করলা ভাজা দিয়ে খেয়ে নাও। আজ আর ডাল হয়নি। ছাঁচি কুমড়ো আছে
          খানিকটা নারকেল কুচি তরকারির ওপর থেকে তুলে নিয়ে মুখে দেয় ইন্দিবর। ভালো লাগে। তেতো ভাবটা কেটে যায়। রুদ্রাণীর দিকে তাকিয়ে খানিকটা নরম গলায় জিজ্ঞেস করে, “কী আনব?”
          রুদ্রাণী অবাক হয় একটু। বুঝতে পারে না।
          “শনিবার যাবে না?” অল্প একটু ভাতে পুরো তরকারিটা মাখতে মাখতে জিজ্ঞেস করে ইন্দিবর।
          “বাকি ভাতটা শুধু মাছ আর চাটনি দিয়ে খেতে পারবে?” অনুযোগের সুরে বলে রুদ্রাণীবুঝতে পেরেছে ইন্দিবর কী জানতে চাইছে। তবু এড়িয়ে যেতে চায়।
          “এত ভাত খাব না” খানিকটা ভাত হাতের চেটোটাকে আড়াআড়ি করে কৌণিক কোদালের দক্ষতায় তরকারির পাশে আলতো ছোঁয়ায় টেনে আনে ইন্দিবর।
          “সারাদিন এইটুকু খেয়ে থাকবে? টিফিনও তো নিলে না
          “এক গাদা ভাত খেয়ে কী হবে? একই রকম না খেয়ে নানারকম খেতে হবে। ভাত দিয়ে তরকারি না মেখে, তরকারি দিয়ে ভাত মাখা অভ্যেস করো
          ইন্দিবর খেতে খেতে কথা বলে যায়। তার আচরণের বৈপরীত্যগুলো ঠিক মেলাতে পারে না রুদ্রাণী। শুনতে শুনতে উদ্বাস্তু হয়ে যায় মন। এই মানুষটাই একদিন গান শোনার সময় উঠে গিয়ে সুইচ অফ করে দিয়েছিল। বলেছিল, “একদম এইসব গান চালাবে না। এগুলো মানুষকে স্বার্থপর করে দেয়” রুদ্রাণী অবাক হয়েছিল। ‘তুমি আর আমি/ এতটুকু বাসা/ এই নিয়ে আমাদের পৃথিবী’ কী এমন ছিল গানটাতে যে নষ্ট হয়ে যেতে পারে একটা পরিণত মন? রুদ্রাণী বুঝতে পারেনি। আজও পারে না
          “তুমি কিন্তু প্রশ্নটার উত্তর দিলে না
          ভাতের কুয়ো থেকে কালবোশ মাছের গাদা-পেটি মেশানো টুকরোটা সরিয়ে লঙ্কা ডলতে ডলতে বাক্যটা আধাখ্যাঁচড়া ছেড়ে দেয় ইন্দিবর।
          “কী কথা?”
সূক্ষ্ম টানে পিঠ অংশের ওয়াই কাঁটাগুলো বার করে নিতে নিতে একবার আড়চোখে তাকায় ইন্দিবর। রুদ্রাণী বাড়িতেও শাড়ি পরে মাঝেমধ্যে। না পরলেও বলবার কে নেই। কিন্তু ভালোলাগে হঠাৎ হঠাৎ। চেনা খাঁজে অচেনা পেলবতা। কাছে এলে কোথায় যায়?
রুদ্রাণী আর কিছু জিজ্ঞেস করল না দেখে নিজেই বলে, “তুমি জানো না শনিবার কী আছে? না বলতে চাইছ না যে নিজের মার জন্য যা কেনার নিজেই আনবে?”
“তোমাকে বাবা এখনও পর্যন্ত বলেছে কিছু?” নিস্পৃহ স্বরে জিজ্ঞেস করে রুদ্রাণীএবার চুপ করে যায় ইন্দিবর স্বয়ং। খানিকক্ষ পেটির অংশের সরল সিধে কাঁটাগুলো আঙুল দিয়ে সহজেই টেনে টেনে বার করে মাছটা ভাত দিয়ে মেখে খুব ধীরে ধীরে চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে থাকে। তার খাওয়ার ধর দেখে পেশাদার পুষ্টিবিদের দক্ষতায় পরামর্শ দেয়া যোগগুরুর উপদেশ মনে পড়েঅল্প অল্প গ্রাস তুলে অনেকক্ষণ ধরে মুখের ভেতর পাকলে পাকলে তারপর ভালোভাবে চিবিয়ে তবে একটু একটু করে গিললে, হজম ভালো হবে। বেশি খাওয়া হবে না। পেট পরিষ্কার হবে সহজে” রুদ্রাণীর প্রশ্নটাকেও কি ওইভাবেই হজম করে নিচ্ছে ইন্দিবর?

২.

“সকাল থেকে ফেসবুক-হোয়্যাটসঅ্যাপের বাইরে কোনো কিছু কাজ আছে তোমার?” হালকা বিরক্তি নিয়ে ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারটা ঠেলে দিল বেদান্ত।
“আরে দেখো না, ইলিনা এমন মজার মেসেজ পাঠায়—’’
“রাখো তো তোমার ইলিনা!” অতিশয় বিরক্তি প্রকাশ করে বেদান্ত বলে, “চন্দন কাঠের কাপলিং দুটো কোথায় গেল?”
মুখে আদুরে পুলকের বিভা ছড়িয়ে রেখে, চোখ না তুলেই ইন্দ্রাণী বলে, “বাথরুমের জানলার ধাপিতে দেখেছ?’’
মুখ দিয়ে অদ্ভুত একটা আওয়াজশব্দ ছুঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বেদান্ত। তার চলে যাওয়ার ধরটায় বোধহয় একটু সতর্ক হয় ইন্দ্রাণীফোনটা হাতে নিয়েই উঠে আসে পিছু পিছু।
“ধ্যাত্তেরি! আজ আর অফিসের গাড়ি পাব না, সেই নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করেই
বাথরুম থেকে একরাশ হালছাড়া মনোভাব নিয়ে বেরিয়ে এসে ধপ করে সোফায় বসে পড়ে বেদান্ত।
এবার সত্যিই ফোনটা থেকে মন উঠে যায়। “কী হল?” বলে উদ্বিগ্ন মুখে এগিয়ে আসে ইন্দ্রাণী
“চান করে বেরুবার সময় ওয়াইপার দিইনি মোজাটাই ভিজে গেল
ইন্দ্রাণী বুঝতে পারে না কী করা উচিত। বেদান্ত এখন রাগে ফেটে পড়তে পারে। অথবা ঝোঁকের মাথায় বলেই দিতে পারে, ‘ধুত্তেরি অফিসে যাবই না আজ’।
যদি প্রথমটা হয় তাহলে দাঁতে দাঁত চিপে কথাগুলো হজম করে নিতে হবে। জামাইষষ্ঠী নিয়ে ইলিনার পাঠানো মেসেজটাই যত নষ্টের গোড়া। ভাগাড়ের মাংস, মড শাশুড়ি আর বিয়রের ব্র্যান্ড নিয়ে ভায়রাভাইদের ঝগড়া এইসব মিলিয়ে চটুল জোকসের এমন একটা সিরিজ পাঠিয়েছে যে পড়ে শেষ না করে থামতে পারছিল না। এখনও মনে পড়লে পেটের ভেতর থেকে একটা হাসি ঘুলিয়ে উঠছে। ইন্দ্রাণী সতর্ক হবার চেষ্টা করল আপ্রাণযদি হেসে ফেলে বাই চান্স তাহলেই দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা চাগাড় দিয়ে উঠবে। দুড়দাড় করে পোশাক-আশাক খুলে ল্যাপটপ নিয়ে উপুড় হয়ে পড়বে বিছানায়।
ব্যাস, তখনই জ্বালা। একে তো তাহলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা সাপ্লাই করতে হবে। দুবার ভাত খাবে না একদিনে। তাই দুপুরে আবার সুস্বাদু কিছু করে দিতে হবে। এন্তার ফোন আর ডেটা খরচ করে বাড়িটাকে, বলা ভালো বেডরুমটাকেই অফিস বানিয়ে তুলবে। সবচেয়ে বড় কথা ইলিনার সঙ্গে মার্কেটিং প্ল্যানটাই ভেস্তে যাবে একেবারে। বরকে একা ফেলে বেরুনো যাবে না। যথেষ্ট পারমিসিভ। অ্যাকমোডেটিভও। কিন্তু যদি কাজের নেশায় একবার ডুবে যায়, বিরতিতে মনে পড়বে বউয়ের কথা। তখনই কাছে চাই। শুরু করবে অসময়ের উৎপাত
কিন্তু এসব কিছুই না ঘটিয়ে, নিজের মনেই গোঁজ হয়ে থেকে, বেদান্ত শোয়ার ঘর থেকে নতুন মোজা এনে, ভিজেটা বেসিনের তলায় দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে, জুতো পরতে বসে যায় সিটওলা শু-র‍্যাকের ওপরফ্রিজের মাথায় যে টাওয়েলটা থাকে তার নীচে কাপলিং দুটো আগের দিন রেখেছিলহঠাৎ খেয়াল পড়ে ইন্দ্রাণীর। ইতস্তত করে বার করে। হেসে ফেলে বেদান্ত। “আমিই রেখেছিলাম না?”
“এদুটো না লাগিয়ে গেলে বাবুর বুঝি আভিজাত্য জমে না?” জামার হাতায় পরিয়ে দেওয়ার আগে চন্দনের সুঘ্রা নিয়ে জিজ্ঞেস করে ইন্দ্রাণী
বেদান্ত কিছু বলে না। মুখে হালকা হাসি। তাকিয়ে থাকে বাঁ হাতেরটা লাগাতে গিয়ে ইন্দ্রাণীর নাজেহাল মুখের দিকে।
“কিছু ভুলে যাচ্ছ না তো?”
হঠাৎ প্রশ্নে অবাক হয় ইন্দ্রাণীএক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপরই উথলে ওঠে আবেগ। আর্দ্র গলায়। “তুমি কার্ডটা দিলে না তো!”
বেরুবার ঠিক আগে পার্স থেকে ইপ্সিত আয়তক্ষেত্রটা বার করে চালান করে দেবার ফাঁকে বেদান্ত চোরা প্রশ্রয়ের চোখে টুকে দেয়, “দেখো, মায়ের জন্য কেনার নামে একগাদা ধসিয়ে দিও না যেন!”
একলহমা ভেবে নিয়েই ঝিলিক দিয়ে ওঠে উত্তর। “দেখো, ষষ্ঠীতে এমন খেলে যে রোববারটা হাসপাতালেই কাটাতে হল, এমন যেন না হয়!”

৩.

“আরে আমরা বলি অরণ্যষষ্ঠী। সাঁওতালরা বলে চাডিকুটাম। আপনাদের সভ্যতার থেকেও অনেক পুরানো প্রথা এটা
দয়ারাম সর্দার এরকম আক্রমণাত্মক কথা মাঝেমধ্যে বলে ফেলে স্টাফরুমে। প্রথম প্রথম রেগে যেত অনেকে। জয়েন করার মাসখানেকের মধ্যে নাইটগার্ড খুন হল ইস্কুলে। এইসব ঝঞ্ঝাটের দিনে ছুটি নিয়ে নেওয়াই দস্তুর ইন্দিবরের। কিন্তু সময়মতো খবর না পাওয়ায় গিয়ে পড়তে হল অগ্নিকুণ্ডেহেডমাস্টারকে ঘিরে বাঁদরনাচ নাচছে গুটিকয়েক স্যাঙাত সমেত স্থানীয় মাতব্বর। সে তখন ক্ষমতায় থেকেও পার্টিতে কোণঠাসা। কোনোক্রমে একটা কিছু ঘটিয়ে তুলে আত্মপ্রতিষ্ঠা করা দরকার। চিৎকার করে আঙুল তুলে বলছে, “আপনি গ্রামের মানুষকে অপমান করছেন!”
হেডমাস্টারের অপরাধ? মাতব্বর বলছিল, “আপনি ওকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন, স্কুলের কম্প্যুটার বা কিছু খোয়া গেলে ওর মাইনে থেকে কাটা যাবে। তাই আপনার জন্যই ও খুন হয়েছে, আপনিই ওকে খুন করিয়েছেন
প্রধান  শিক্ষক চুপ করে সব শুনে যাচ্ছিলেন। কথাটা ঠিক। সামান্য স্কুলের ফান্ড। কটাই বা ছাত্র আছে? স্থায়ী পদে লোক দেওয়ার কথা সরকারের। তা নয়, কমিটি ব্যস্ত নানান ফিকিরে নিজেদের লোক গুঁজে দিতে বিভিন্ন ফাঁকা পদে। তখন বাধ্য হয়েই নানান শর্ত চাপানো। যাতে অন্তত কিছুটা বেঁধে রাখা যায়। তবু মদের ঘোরে বেঘোরে প্রাণ দিল ছেলেটা। নিয়মিত খেত। জানত সবাইডাকাতদের রোখার চেষ্টাও করেছিল হয়তো সিম্পলি কুপিয়ে দিয়ে গেছে। ভারাক্রান্ত মনে সব কথা শুনে যচ্ছিলেন চুপ করে। কিন্তু ধৈর্যচ্যুতি ঘটাল শেষ বাক্যটা। “আপনিই ওকে খুন করিয়েছেন!”
মুখে কোনো কথা না বলে বিতৃষ্ণাসূচক ঠোঁট বেকানো হাসি হেসেছিলেন বিদ্যালয় প্রশাসনের উইকেটকিপার। ব্যাস, আর যায় কোথায়। সঙ্গে সঙ্গে টেবিল চাপড়ে তীব্র প্রতিবাদ। “মজা মারছেন? জানেন আমি ব্লক সভাপতি!”
বাদানুবাদের পুরো পর্বটায় দুবার বাথরুমে গেছিল ইন্দিবর। ভীষণ ইচ্ছে করলেও একবারও ধরাতে পারেনি একটা বিড়ি। দু’-একটা টান দিলেও একটু টেনশন লাঘব হতএইসব সময় পেট গুড়গুড় করে বেগ ওঠে। রুদ্রাণীর এক কাকা বলেছিলেন, “জেলসিয়াম”
“আপনি ওইভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?” আবার মাতব্বরের ধমক। চমকে উঠেছিল ইন্দিবর। না, তাকে নয়। পাশে বসা দয়ারাম লক্ষযে তখন তিনদিনের জ্বরে ভুগছে। চোখ দুটো জবা ফুল। স্থির লালচে দৃষ্টি রেখে সোজাসুজি বলেছিল, “দেখছি!”
সেই থেকে দয়ারামের খুব খাতির। অনেক দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে, এগ্রিকালচারে এম এসসি। আলুর সা রোগের ওপর পিএইচডি। কথা বলে কম। কর্মশিক্ষায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। কোনো কাজে আপত্তি নেই। কিন্তু আপাত বেফাঁস কথা বলায় জুড়িহীন।
“কী রকম ব্যাপার দয়া? সভ্যতার আমরা-তোমরা করছ! শুনি কেসটা” বলে জমিয়ে বসেন ইতিহাসের জটাশংকর গঙ্গোপাধ্যায়।
“আমাদের ছেলেদের বিয়ের পর দুদিনের একটা ট্যুরে যেতে হয়। বরযাত্রী নিয়ে
“ট্যুর! তোমাদের ট্যুরিজমও আছে নাকি?” ফোঁড়ন কাটে ভূগোলের মানসী কর্মকার।
দয়ারাম একবার তাকায়। উপেক্ষা করে। “ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। ওরা বনে যায়। ওই দুদিন শিকার করে বাঁচতে হবে। শিকার আনতে হবে। তারপর বিয়ের জায়গায় ফিরলে হাত-পা ধুইয়ে দেওয়া হবে
“কার? নতুন বয়ের!” উৎসুক হয়ে ওঠে রণিতা হালদার।
“চুপ কর তো! এই বুঝলি এতক্ষ?” তাকে থামিয়ে দেয় বাংলার কবিতা সামন্ত। “দয়ারামদা বলুন তো আপনি”
জটাশংকর মুচকি হাসে। দয়ারাম বলতে থাকে, “আসলে বনকে কেন্দ্র করে একদিন যে জীবন শুরু হয়েছিল, বিয়ের সময় তাকে জড়িয়ে নেওয়াই অরণ্যষষ্ঠী। আমরা ওঁরাওরা বনেই থাকতাম।  সাঁওতালরা থাকত বনের ধারে ধারে। ফলমূল, শিকার, প্রকৃতি তো ঢেলে দিয়েছে। ওদের বরটা শিকারে যায় না বোধহয়। দিদিমণি বুঝলেন? বউয়ের নয়। ছেলের পা ধুইয়ে তাকে পোশাক-আশাক  খাওয়াদাওয়া দেওয়া হয়। সবটা মেয়ের বাড়িতে। ছেলে এবার অ্যাডাল্ট হল। অস্ত্র ব্যবহার শিখলখাদ্যের জন্য। তার আগে পারমিশান নেই। ম্যাচুরিটি নেই। এবার সংসার টানতে পশু মারবে
ছেঁড়া ছেঁড়া বাক্য। বাঁকুড়া জেলার ছাতরা থেকে উঠে আসা গলায় শহুরে শব্দের মিশেল। সবাই শুনে যায়মন্ত্রমুগ্ধ।
“আপনাদের লব-কুশ তো পরে এলআমাদের ওসব নেই। নাবালকের শিকারে যাওয়ায় নিষেধ। ওই অর্ধনারীশ্বর আছে না। এই ষষ্ঠীর সঙ্গে কী একটা ব্যাপার আছে ঠাকুমা বলত মনে পড়ছে না
দয়ারাম থেমে যায়। একটু আত্নমগ্ন। জানলার বাইরে দৃষ্টি। কবিতা উখু করে। কী একটা বলবে-বলবে ভাব। বলেই ফেলে: “আচ্ছা দয়ারামদা, বানা জামাইষষ্ঠীটা কী?”
মনটা আবার জানলার রড গলে ঢুকে আসে অফ পিরিয়ডের অলস ঘরে। “ওটা তো কালীপুজোর অমাবস্যা তিথিতে হয়। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের অনেক জায়গায়। নতুন ব স্বামীসহ বাপের বাড়িতে আসে। আবার একদিন বাদে দ্বিতীয়ার দিন ভাইফোঁটাও হয়
এই জায়গা থেকে খপ করে কথার খেই ধরে নেয় ইতিহাসের জটাশংকর গঙ্গোপাধ্যায়। “আসলে মালভূমির অরণ্য সংলগ্ন অঞ্চলেই সভ্যতা থিতু হতে থাকে। কৃষি আসে পরে। পাহাড় যৌতুক দেওয়া হত বিয়েতে। যাও, ওখানে গিয়ে পুরুষত্ব দেখাও। প্রমাণ করো সংসার প্রতিপালনে কতটা সমর্থ হয়েছ তুমি!”
নেতাসুলভ বক্তৃতা শুনলেই নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া অভ্যেস দয়ারামেরকথা পছন্দ হলে শুধু তাকিয়ে থাকে বক্তার মুখের দিকে। না হলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দয়ারাম তাকিয়ে রইল। জটাশংকর বকে যায় নিজের তালে।
“এই যে ধরো বাধনাষষ্ঠী। শব্দটা লক্ষ করো। দুটো পরিবারের বন্ধন। পুরানো পরিবারে বন্ধন ছিল ভাই-বোন। নতুন পরিবারে কন্যা-জামাতা। দুটোকে মিলিয়ে দাও একটাই উৎসবেপ্রথমে জামাইষষ্ঠী। তারপর সেই জামাইয়ের উপস্থিতিতেই ভাইফোঁটা। দুই পরিবারের দুই বন্ধনকে নতুন সম্পর্কে বাঁধ্ না
বলার সঙ্গে সঙ্গে কোনোক্রমে সিগারেটটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে দুই হাত যূথবদ্ধ করে এমন একটা সংগ্রামী মুদ্রা করেন জটাশংকর যে মানসী আর রণিতা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় হেসে ওঠে। দয়ারাম একবার স্থির চোখে তাকায় তাদের দিকে। কী মনোভাব বোঝা যায় না। জটাশংকর সামলে নেয় পড়ন্ত সিগারেটটা।
অস্বস্তি বাড়তে থাকে ইন্দিবরের। পরিবারে পরিবারে বন্ধন মানেই কাছাকাছি আসা। বেশি ঘনিষ্ঠতা। দূর থেকে চকচকে মসৃণ মনে হয় যেটা, কাছে এলে তাতেই ফুটে ওঠে ব্রণর উঁচু-নীচু। তুলনাও এসে যায়। কর্পোরেট আর সরকার পোষিতর ফলাফলের পার্থক্যে। কেউ মুখে বলে না। মনেও ভাবে না হয়তো সবসময়। তবু এসে যায়। ইন্দিবর স্টাফরুমের আড্ডা থেকে হারিয়ে যায়। ছোটোশালী কত মজা করে। বলে, জাম্বু! জামাইবাবুর শর্ট ফর্ম? নিজেকে জাম্বুবানই মনে হয় ইন্দিবরের। ইস্কুলে ঢোকার মুখেই দেখেছিল ভায়রাভাইয়ের সংজ্ঞাএকই কম্পানির ডিফেক্ট মাল কিনে ঠকে গেছে যে ক্রেতারা। পাঠিয়েছে ইন্দ্রাণীসঙ্গে ফুটনোট: আমি তো জানতাম তোমরা মাসতুতো ভাই। বাক্যটার শেষে দাঁড়ি ছিল নাএকটা এক চোখ টেপা ইমোজি আর জানতামের পর তিনটি ডট। মন ভালো হয়ে গেছিল অটো থেকে নামতে নামতে। রুদ্রাণীর বাবা এখনও বলেননি শনিবারের কথা। তার কীসের গরজ শাশুড়ির জন্য কিছু কেনার?
হোয়্যাটসঅ্যাপটা আর-একবার খুলতে একগাদা মেসেজ এললাফিয়ে উঠল মেসেঞ্জারের একটা গোলিরক্তিকর। আঙুলের একটানে নীচের কাটাচিহ্নে ফেলে দিল ইন্দিবর। রুদ্রাণী লিখেছে, ‘ফেরার সময় ফোন কোরো’। এই এক বাজে স্বভাব। কী দরকার বলে রাখো। তা নয় ঝুলিয়ে দেওয়া। ইন্দ্রাণীর আর-একটা মেসেজ। ‘এবার আমার শাশুড়ি ভাগাড়ের ভয়ে বাড়িতেই ব্যাপক খাওয়ার আয়োজন করেছে। ইলিনা বলেছে, ল্যাম্ব খাওয়াবে মা? তোমাদের কপালে মনে হয় কাচকলা জুটবে! দিদি বলেছে কিছু?’
ইন্দিবর আবার মলিন হয়ে যায়। শাশুড়ির সঙ্গে জমে না ঠিক। কেমন ভেতরগোঁজা টাইপের। ছোটজামাইটা উচ্চপদের চাকুরে হবার পর থেকেই কী!
“আরে জোড় ভাঙাও একটা ব্যাপার। দয়ারামদা কী বলছেন সেটা বুঝেছিস?” কবিতা সামন্ত আবার উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। তার কণ্ঠস্বরের তীক্ষ্ণতায় চটকা ভাঙে ইন্দিবরের। কবিতা বোঝাচ্ছে মানসীকে। “আমাদের অষ্টমঙ্গলা আর ওনাদের আটমংলা একই অনুষ্ঠান। খালি পার্থক্যটা হচ্ছে অষ্টমঙ্গলা থেকে ফিরে আসার পর মেয়েকে একা তার বাপের বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আচ্ছা, দয়াদা, এইরকম ভাবে নতুন বিয়ের পরই ওই যে একড়িয়া না কি বললেন, তা ওইভাবে আবার জোড় ভেঙে দেবার কারণটা কী?”

৪.

অদ্য যে অরণ্যষষ্ঠী বিদিত সংসার।
    আমিষ ভোজন কর দেখি কদাকার।।
                          কৃষ্ণরাম দাস

“এই বয়সে একা হাতে ছ জনের রান্না করা খেলা কথা? তুমি বললে না কেন, না এলে মাইনে কেটে নেবে?”
চায়ের কাপটা ডানদিকের পাতা থেকে তুলে কাগজটা চার ভাগের এক ভাগে ভাঁজ করে বাঁদিকের একটা খবরে মনোনিবেশ করে অর্ঘ্যকমল। তার এই নির্লিপ্ত ভঙ্গীমা উৎক্ষিপ্ত করে তোলে চন্দ্রাণীকে। এগিয়ে এসে কাগজটা নিয়ে নেয় একটানে। নিখাদ বিরক্তির প্রাথমিক অভিব্যক্তি আত্মস্থ নিয়ন্ত্রণে মুছে ফেলে নির্লিপ্ততর মুখ তোলে অর্ঘ্যকমল। “কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে মানে? এই যে অত বড় ইলিশটা এনে রেখেছ, সতী না এলে কে ওটা রাঁধবে তোমার সুপুত্তর জামাইদের জন্য?
“কী করব? সতী তো বলল ওকেও লাগবে জামাইষষ্ঠীর প্রস্তুতিতে। ওর মা বারবার করে বলেছে
“তা বলে আগের দিন থেকে গিয়ে পড়ে থাকবে? পেঁয়াজ-রসুন না বেটে করলে খুলবে দেশি মুরগির স্বাদ? সে-ও তো ফ্রিজে ঢুকিয়েছ একগাদা
“ষষ্ঠীর আগে আগে বড্ড দাম বেড়ে যায়। এবারে তো তায় উইক এন্ড। আগুন লাগবে। তাই একটু-একটু করে কিনে রেখেছিলাম। সতী তো বলেনি তখন
অর্ঘ্যকমল চুপ করে যায়। একটা ফাউল হয়ে গেল হঠাৎ? তাকে মাঝপথে কথা কেটে দিতে দেখে ফুঁসে ওঠে চন্দ্রাণী, “কী হল? কী বলেছিল সতী তোমায়?
অর্ঘ্যকমল বলতে চায় সতী বলেছিল, ‘‘ওইদিন মা তো পুজো করে। অনেকদিন বিয়ে হয়েছে আমার। বাচ্চা হচ্ছে না, কাকাবাবু। তোমার জামাইয়ের কল্যাণ কামনায় কত কিছু করবে মা। ওইদিন সব নিরামিষ। তাই রান্নার চাপ থাকবে অনেক। আগের দিন থেকে জোগাড়-যন্তর করে একটু সাহায্য না করলে তুমি একটু কাকিমাকে বুঝিয়ে বলো না
চন্দ্রাণীকে এতকিছু বুঝিয়ে বলা কষ্টকর মনে করে অর্ঘ্যকমল শুধু ডানহাতটা বাড়ালফের শুনতে হল খ্যাঁচানি। “কী চাইছ?”
“কাগজটা দাও
“না। আমি খেটে মরব আর তুমি চা দিয়ে খবর গিলবে হবে না। সতীকে ফোন করো, বলো, কাল সন্ধেবেলা এসে কিছু কাজ করে দিয়ে যাক!”
শান্ত স্বরেই অর্ঘ্যকমল কাগজটা চায় আবার। একটু আগে যে বিরক্তিটা অগোচরে মুছে ফেলেছিল অর্ঘ্যকমল তারই অপ্রকাশিত অংশটা খুঁড়ে এনে এবং তাকে দ্বিগুণ মাত্রায় প্রকাশ করে চন্দ্রাণী কাগজটা ছুঁড়ে দেয় বিছানার ওপর। নিজেও বসে পড়ে ধপ করে।
পরম ধৈর্যে দলা পাকানো বিশ্ববার্তাটি পুনর্বিন্যস্ত করে, মনে মনে নিজের কর্মজীবনের সেই সহকর্মীর কথা ভাবতে ভাবতে, যিনি সকালে কেরানির টেবিলে বসামাত্রই কেউ তার কাগজ চাইলে বলতেন, ‘আছে তবে দেওয়া যাবে না এখন। আমি এখনও পর্যন্ত একটাও লাইন পড়তে পারলাম না আর তোমরা সবটা ফ্যাদাফেদি করে ফের দেবে, ওটি হবে না’ এবং চন্দ্রাণীর চরম ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে, ধীরেধীরে, আক্রান্ত হবার আগে যে বামপৃষ্ঠায় থিতু হতে চেয়েছিলেন, তাতে ছাপা একটা খবরকে, তিন ধাপে পাতাটা মুড়িয়ে, মেলে ধরলেন চন্দ্রাণীর সামনে।
“কী দেখব? আমার শ্রাদ্ধ কবে লিখেছে ওতে?”
গলার ঝাঁঝ ফিরিয়ে আনতে আনতে চন্দ্রাণী হেডলাইনটা পড়ে: ‘জামাই ষষ্ঠীতে সবেতন ছুটির দাবি জানিয়েছে পরিচারিকা ইউনিয়ন
“ধ্যা!” বলে কাগজটা মুখের সামনে থেকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে চন্দ্রাণী বলে, “তাহলে ওদের আসতে বললে কেন? দোকান থেকে পোলাও-কাবাব আনিয়ে খাইয়ে দাও
স্মিত হেসে চশমাটা খুলে ভাঁজ করে রাখতে রাখতে অর্ঘ্যকমল উত্তর দেয়, “বলিনি তো এখনও। এই পারমিশনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম

৫.

“কালো তিনশো টাকা ধার চাইছিল। বলছিল, আগামী তিন মাসের মাইনে থেকে একশো করে কেটে নিতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার? প্রথমে ভাবছিলাম, কিছু বলব না, দিয়ে দিই। আবার যদি ওর ছেলেটার সেই ঘুসঘুসে জ্বরের ব্যাপার হয় আর ডাক্তার-বদ্যি করে একগাদা টাকা লাগে তাহলে তুমি রাগ করবে। তবু জিজ্ঞেস করে ফেললাম। ছেলেটার মুখটা মনে পড়ে গেল। এত মিষ্টি, তোমার মনে আছে, মার সঙ্গে এসেছিল একদিন? সেদিনও ওর জ্বর ছিল। সিঁড়ির পাশে একটা রেকাবিতে মুড়ি দিলাম। মায়ে বাসন মাজছে, ঘর ঝাঁটমোছ করছে আর ছেলেতে চুপচাপ একটা-একটা করে মুড়ি তুলে তুলে খাচ্ছে। খালি যখন খুব কষ্ট হচ্ছিল, বলছিল, মা, বাড়ি চলো না” চিঠি লেখার মতো একটানা বকে যাচ্ছে রুদ্রাণী। সহকর্মীসহ মুখচেনা সহযাত্রীও রয়েছে দু’-একজন। ইন্দিবর জবাব দেয় না। চুপ করে শুনে যেতে যেতে এক সময় ধৈর্য মাত্রাছাড়া হলে বলে ফেলে, “আঃ, মূল কথাটা বলো না!”
“হ্যাঁ, বলছি তো, ওকে জিজ্ঞেস করলাম, কী দরকার। বলল, একটা শার্ট কিনতে হবে। আমি তো অবাক। ছেলের জন্য? না। কী বলে জানো? বরের জন্য! মানে? বেশ কটা প্রশ্ন করে বুঝলাম, ওর মা জামাইষষ্ঠীতে গুণধর বাবাজীবনকে ওটা দেবে। এদিকে হাতে টাকা নেই। হাইরোডের ধারে কী একটা বারে কালোর বাবা কাজ করত। সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই মেয়ের কাছেই হাত পেতেছে। পরে শোধ করে দেবে
স্টেশন এগিয়ে আসছে। অটোয় উঠেই ফোন করেছিল। বুকপকেটে খুচরো বের করে রাখা হয়নি। নেমেই মানিব্যাগ বার করতে হবে। শুনতেও ভালোলাগছে না কথাগুলো। বিরক্তিসূচক চাপা গলায় ইন্দিবর জিজ্ঞেস করে, “তা আমায় কী করতে হবে সেটা বলো না!”
“আমি বলে দিয়েছি, আর অ্যাডভান্স দেওয়া যাবে না। দাদাবাবু রাগ করে। হিসেব রাখতে অসুবিধা হয়আমি শার্টটাই একেবারে কিনে দেব। তাই বলছিলাম, ইস্কুলফেরতা তুমি ওই তিন-চারশোর মধ্যে একটা কিছু কিনে আনবে?”
অটোওলার হাতে কোনোক্রমে টাকা গুঁজে, একটা কলার ঝুড়িতে হোঁচট খেয়ে ও সেই তালেই দ্বিতীয় ধাপে শুয়ে থাকা হৃতযৌবন, লোমওঠা কুকুরটাকে টপকে গিয়ে, ওভারব্রিজে উঠে এবং নীচে পড়ে থাকা তিনটে প্ল্যাটফর্মকে পার হয়ে গিয়ে, দুড়দাড় করে নেমে অনাকাঙ্ক্ষিত শেষ কামরার শেষ দরজার দিকে দৌঁড়ে পৌঁছুবার মধ্যবর্তীতায়, ইন্দিবরের মনে পড়ছিল হেডস্যারের কথা। দর্শনে এম এ। মিড-ডে মিল, নির্মল বিদ্যালয় অভিযান, স্বাস্থ্য কর্মসূচি, অনগ্রসর কল্যাণ, অডিট, লেজার, পিএফ, সার্ভিস বুক, ইত্যাকার ব্যাপারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত অবস্থায় যদি তাঁকে অ্যাকাডেমিক বিষয়ে কোনো সহকর্মী নেহাতই ভুলবশত কোনো প্রশ্ন করে ফেলেন তবে তাঁর একটাই উত্তর, “গাধা!”
“মানে স্যার?” প্রশ্নকর্তা স্বভাবতই বিড়ম্বিত।
“অগাধ শুনছ?”
“হ্যাঁ, স্যার, ওই যে বলে অগাধ জ্ঞানের আধার
“রাইট। তার মানে গাধ হল অগভীর। সব বিষয়ে ভাসা ভাসা জ্ঞানের আধার আমি। গাধ যোগ ” হেডস্যার হাসছেন মিটিমিটি। চোখ কম্প্যুটারের এক্সেল ফাইলে। আঙুল মাউসে। যিনি জানতে এসেছিলেন তাঁর হয়তো খেয়াল পড়ল, বিদ্যালয়ের একমাত্র করণিক নেই বছর চারেক। কিন্তু সরকার বাহাদুর এখনও পরীক্ষানিরীক্ষা করে কাউকে পাঠাতে পারেননি এখনও। তাই তিনি আর জিজ্ঞেস করলেন না, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিজ্ঞান ও পরিবেশ একটা বইয়ে থাকা সত্ত্বেও ভৌতবিজ্ঞান ও জীবনবিজ্ঞান এই দুই ভাগে ক্লাস রুটিন করা উচিত কিনা। তাকে গুটিগুটি বেরিয়ে যেতে হেডস্যারই গলা তোলেন, “আমাদের তো আধ্যাত্মিক দেশ। একটা শব্দের দুটো মানে থাকে। তোমাদের হেমাস্টার একইসঙ্গে পল্লবগ্রাহী আর মোটবাহক!”
ট্রেনে উঠে চতুর্থ ব্যক্তির হাফঝোলা সিটে বসে একটা অনভ্যাসের দিলখুস খেয়ে মুখের বিস্বাদ ভাবটা কাটাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে ইন্দিবর। গোঁতাগুঁতি করে শরীরের ভারসাম্য একটু ধাতস্থ হয়ে এলে মোবাইলটা আবার ঘাটার একটা বিতৃষ্ণাময় ইচ্ছে চাগাড় দিতে থাকে। এই সময়েই জানলার ধারে বসা ভাগ্যবানটি বলে, “একটা পা বাইরে করে বসুন তো! চাপছেন কেন?”
ইতিমধ্যেই বাঁ-পাটা একটা বাদামওলা মাড়িয়ে গেছে। তর্কে জড়াতে ইচ্ছে করে না। খিদেও পাচ্ছে খুব। মনে হল ওর কাছ থেকেই বাদাম কেনা যাক। সকালে মেসেঞ্জারে কী একটা এসেছিল। না দেখে ফেলে দিয়েছিল কাটা চিহ্নে। ইন্দিবর শুধু বলে, “আপনি একটু সরু হয়ে বসুন
লোকটা গজগজ করে কী বলছে তা আর কানে যায় না। ততক্ষণে মানুষের মুখহীন জলাশয় ডিপি আঙুলের কৌতূহলী চাপে মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে ফুটিয়ে তুলেছে চিনচিনে ব্যথা:
‘তোকে অ্যাড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছি। অ্যাকসেপ্ট করিসনি কেন? আমি প্রমীলা। চিনতে পারছিস না! বিএড কলেজ কাটা দুপুরগুলো ভুলে গেলি নাকি? তোর তো আমার সঙ্গে আগামী মঙ্গলবার আমাদের বাড়িতে আসার ছিল
লেখাটা যতিচিহ্নহীনভাবে শেষ হয়েছে একটা ফাজিল হাসির ইমোজি দিয়ে। কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার মধ্যেই কর্কশ রিংটোনে ভেসে উঠল: ইন্দ্রাণী কলিং...

No comments:

Post a Comment