নাকবা ।। ভাষান্তর : সোহেল ইসলাম

বাক্‌ ১৪১ ।। 





ইজরায়েলের পালেস্তাইন দখল, অবরোধ, খুনখারাপি ও গোলাবর্ষণ নতুন কোনও ঘটনা নয়। এর শুরুটা অনেক আগে থেকেই। ১৯৪৭ সালে আরব ও ইজরায়েল যুদ্ধের কথা যারা জানেন তারা নিশ্চয় মনে করতে পারছেন, সেই বীভৎসতা। ইজরায়েলি সামরিকের অকথ্য অত্যাচারের সামনে মাথা নত না করে প্যালেস্তানীয়দের স্বাধীনতার লড়াই আশা করি আপনারা মনে রেখেছেন। প্যালেস্তানীয় গ্রাম, শহর সব দখল করে নিচ্ছে ইজরায়েলীয়রা। লাখ-লাখ মানুষ গৃহহীন। কোথায় যাবে, কী খাবে কিচ্ছু জানে না। তবুও মানুষগুলো লড়ে যাচ্ছে, মাতৃভূমিকে কিছুতেই ইহুদি উপনিবেশকদের হাতে তুলে দিতে চায় না। দিনটা ছিল ১৪ মে, ১৯৪৮। ইজরায়েল নিজেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে ফেলে। রাতারাতি অনুপ্রবেশকারী হয়ে যাওয়া হাজার হাজার প্যালেস্তানীয় এসে জড়ো হতে আরম্ভ করে ইজরায়েল সীমান্তে। নিজের দেশ, নিজের ঘরবাড়ি, জমিজমা ফিরিয়ে নিতে। দিন ১৫ মে, ১৯৪৮। পরের দিন জড়ো হওয়ার সংখ্যাটা অনেক বেড়ে যায়। কেননা এই একদিনের ব্যবধানে প্যালেস্তানীয়রা জেনে গেছে, আজ থেকে তারা নিজের দেশেই অনুপ্রবেশকারী। ফলে ভিড় দেখে ভয় পাওয়া ইজরায়েলীয় নিরাপত্তারক্ষীরা নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে (সেই শুরু যা আজও চলছে) মাটি ও রক্তে মাখামাখি শয়ে শয়ে প্যালেস্তানীয় শরীর। তাতে কী? প্যালেস্তাইন মানেই তো গুলিবিদ্ধ দেয়াল, মায়ের কোলে রক্তাক্ত সন্তানের মুখ, খেতে না পাওয়া মানুষের হাহাকার। প্যালেস্তাইন মানেই আমরা চুপ আর ওরা (প্যালেস্তানীয়রা) লড়ে যাবে নিজের দেশে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের লড়াই।
এবার আসি, আল-নাকবা বা নাকবা কী? নাকবা আরবি শব্দ, যার বাংলা তর্জমা দুর্যোগ অর্থাৎ সহজ করে বললে নাকবা হচ্ছে প্যালেস্তানীয়দের কাছে দুর্যোগের দিন যদি জানতে চান, কবে, কেন, কীসের দুর্যোগ? তাহলে আর-একবার শুরুর দিকটায় চলে যান, যেখানে উল্লেখ পাবেন ১৫ মে ১৯৪৮-র। যেখানে উল্লেখ পাবেন লাখ-লাখ প্যালেস্তানীয়দের নিজের দেশেই অনুপ্রবেশকারী হওয়ার। হ্যাঁ, ১৫ মে দিনটাই হচ্ছে প্যালেস্তানীয়দের কাছে নাকবা দিন যা আজও তারা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলে। প্রতি বছর ওই দিনে ইজরায়েলীয় সীমান্তে দাঁড়িয়ে গোটা বিশ্বের কাছে জানতে চায়আমাদের দেশ আমরা কবে ফিরে পাব?’


বি: দ্র: এখানে যে কবিতাগুলো অনুবাদ করা হয়েছে, তা হলোকাস্টের কবিতা সম্পাদক মাইকেল আর বুর্চের সম্পাদনায় প্রকাশিত। কিছু কবিতায় কবির নাম পাওয়া গেছে, কিছু কবিতায় কবির খোঁজ আজও চলছে। এই অনুবাদের মূল উদ্দেশ্য সেই সময়টাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরব বলেই। আর-একটা কথা, এখানটায় আহতের সংখ্যা, নিহতের সংখ্যা, গৃহহীনের সংখ্যা ইচ্ছে করেই তুলে ধরিনি, কেননা আমি বিশ্বাস করি, সংখ্যা দিয়ে দুঃখ অনুভব করা যায় না, দুঃখ মাপাও যায় না।



.
গাজার শিশুরা
(অজ্ঞাত)

হে গাজার শৈশব
তোমাদের হইহুল্লোড়ে জানালার কাচগুলো ঝনঝন করত
সকালগুলো হয়ে উঠত বিরক্তিকর
বারান্দায় ফুলদানির টুকরো ফেলে রেখে
ফুলের একাকিত্ব চুরি করে পালাতে তোমরা

আজ কোথায় সেসব?
ফিরে এসো ভেঙে চুরমার করার ঔদ্ধত্য নিয়ে
পরাজয়ের চিহ্ন মুছে দিতে
ফিরে এসো
শুধু তোমরা ফিরে এসো আবার




.
খোয়াইস
(অজ্ঞাত)

তোমাদের মতো
আমাদেরও একটা স্বপ্ন আছে
ইহুদি ও খ্রিস্টানেরা মানতেই চায় না

না-বুঝরা ঠিক একদিন দেখবে
ট্রাঙ্কের বিধ্বংসী নল থেকে বেরিয়ে আসছে
আমাদের মতোভীতু গাজার শিশুরা
সেদিন ওরা জানবে,
আমার সঙ্গে এমন নিষ্ঠুরতার কোনও মানেই হয় না




.
কী যায় আসে
খুলুদ সৈয়িদ

এটা জীবন না নরক?
এটা একটা অধ্যায় না শেকলের আংটা?
এটা ঘোর না ঝসলে ওঠা?
কী হবে এত প্রশ্ন করে,
মোদ্দা কথা, কোনটা বেশি জরুরি

সে একজন মানুষ না শিশু
সে সাহস না শুধুই সাহসের ভড়ংধারী
সে কি ব্ল্যাক বেল্ট নাকি শুধুই ঝলকানি
কী এসে যায় তাতে
আসল কথা, সে কি লুকোতে চেয়েছে জীবনব্যাপী
এটা শুরুয়াৎ নাকি শেষ
এটা মৃত্যু নাকি মৃত্যুর ইঙ্গিত
এটা আনুকূল্য না হত্যাকারীর পাঞ্জা
এতে কী-ই বা যায় আসে
কেন আমাদের নামে বারবার আতঙ্কবাদীদের লিস্ট

এই কি আগুন না আগুনের ঝলক
এই কি স্বপ্ন নাকি স্বপ্নের আতঙ্ক
এই কি সেই সুখ না যন্ত্রণা আমাদের
যদিও এতে আমাদের কারোর কিছুই যায় আসে না আর



.
আমি আপনাদেরই শিশু
ইসরা তাহিব

আপনার অনুমতি পেলে
আমিও বাঁচতে চাই
ভালোবাসতে চাই
শিখতে চাই
খেলতে চাই আমাদের জাতীয় খেলা
আমাকে একটু দেখুন
আমি জানি আপনি কতটা জনদরদী

আপনার চোখে
আমি চলেফিরে বেড়ানো শুধুই একটা মাংসের টুকরো
কিন্তু আমারও একটা মন আছে
যেও কিনা হাসে-কাঁদে
এদিকে দেখুন আমার প্রিয়তম স্যার
দেখুন আমার চোখের গভীরে আপনাকে নিয়ে ভয়
এবং বলুন
আমার জন্য কী ধরনের মৃত্য অপেক্ষা করে আছে

আমি মশলা পনির নই,
আমি শুধুমাত্র একটা পরিসংখ্যান নই
কিংবা গণেশের নাড়ু নিয়ে ভেগে যাওয়া ইঁদুরও নই
আমি একটা শিশু
দেখুন ভালো করে, আমি আপনাদেরই শিশু



.
আমাদের থাকা
তৌফিক জায়াদ

লেদা, রামাল্লা, গালিলের পথে পথে অসম্ভবনা
তবু আমরা এখানেই থাকব

যেদিকেই তাকাও
দেয়াল আর দেয়াল
মরুঝড় তোমাকে অন্ধ করে দেবে
ক্যাকটাসের কাঁটা কিংবা
গ্রেনেড থেকে ছিটকে আসা কাচের টুকরোরা
শরীরে খেলবে কাটাকুটি
তবুও আমরা এখানেই থাকব

একদিন দেওয়ালের এপারেই শেষ হয়ে যাবে সব
আমরা শুড়িখানার বাসন চকচকে করব
মাতালকে এগিয়ে দেব গ্লাস
মেঝে দখল করে থাকা কুৎসিত বিষদাঁতওয়ালাদের থেকেই হয়তো
ছিনিয়ে আনতে হবে শিশুদের গ্রাস
তবু আমরা এখানেই থাকব

দেয়ালগুলো পথ আটকে দেবে
আমরা গেয়ে যাব বেপরোয়া গান
ভজনের তালে আওড়ে যাব বিদ্রোহের কবিতা
সেদিন হয়তো হিংসার বিরুদ্ধে পথে নামবে ভি
আমাদের সম্মানে খুলে যাবে কারার ওই লৌহকপাট

লেদা, রামাল্লা, গালিলেতেই আমরা থাকব
গাছেদের ছায়া হয়ে
আমাদের শিশুদের ভরসা হয়ে
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে

আমরা এখানেই থাকব



.
হরেক মাল দশ টাকা
ওলফা দার্দ

দশ
দশ
দশ
যা লেবেন, সব দশ
হরেক মাল দশ
জন্মভূমি দশ
মরুঝড় দশ
রাহুর দোষ তাও মাত্র দশ

দিদিরা, বউদিরা
দূরে দাঁড়িয়ে না থেকে এগিয়ে আসুন
আমাদের প্রচার গাড়ি লক্ষ করে
মৃতদেহ দশ টাকা
ছিন্নবিচ্ছিন্ন অংশ দশ টাকা
বোবা মানবতা
, কানা বোধ
ল্যাংড়া বিবেক সব পাবেন মাত্র দশ
অপরাধ মুক্তি তাও দশ
তারচেও বড় খবর,
আমাদের তরফ থেকে শুধুমাত্র আপনাদের জন্য
আপনাদের জন্য
বিশ্ব নীরবতার পেছন মারুন
মাত্র দশ টাকায়



.
অস্ত্রের সামনে প্রার্থনা
(অজ্ঞাত)

একদা এক যুদ্ধের দেশে
বেড়ে উঠছিলাম আমি
সেখানে প্রথমেই বসন্ত কিডন্যাপ হল
খোদ আমার বাড়ি থেকে কিডন্যাপ হল আমারই শৈশব
ভয়ে বালির তলায় লুকিয়ে থাকা সাপের মতো করে উঠলাম
ঠিক পরের দিনই ঘটে গেল আর-একটা ঘটনা
চুরি গেল আমার চামড়া
যেটার ভয় পাচ্ছিলাম

চামড়া রোদে শুকোচ্ছে, দেখতে পাচ্ছি
তারপর ট্যানিনে ডোবাবে,
শুরু হবে ছাঁচে ফেলার কাজ
অনুগতর মুখ বানানোর প্রক্রিয়া
সব শুধু দেখেই চলেছি

একটু দূরেই আমি
আমার ডাবল এক্সএল শার্ট
আমার না বলতে পারা উচ্চারণ
জিজ্ঞেস করছে আমাকে
কী করবে,
যদি মাইন বিস্ফোরণে
তোমার কবিতারা টুকরো টুকরো হয়ে যায়?
এর উত্তর জানা নেই আমার
ভোরের আকাশে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া

এদিকে যখন
হার্টবিট দ্রুততম সাঁতারুর মতো ছুটে চলেছে
চোখজোড়া হারিয়েছে খেই
মুখ লজ্জায় লাল হয়ে লুকোতে চাইছে মাটিতে
কোনওমতে ঠিকঠাক থাকা আঙুলগুলো
পাগলের মতো খুঁড়েই চলেছে কবর
নাক বাড়ি ফেরার পথ খুঁজছে গন্ধ শুঁকে শুঁকে
ঠিক ওদিকে তখন
পাথরকুচির ভেতর থেকে মাথা বের করে
শিশু তার মাকে বলছে,
ওদের বলো,
ওরা যেন আমার ঘুড়িটাকে নিয়ে না যায়



.
এশার নামাজের প্রার্থনা
(অজ্ঞাত)

এশারের নামাজে প্রার্থনায় বসেছি
প্রদীপের মতো তারারা ঘিরে রেখেছে চারপাশ
প্রার্থনায় বসেছি দিনের পর দিন
বিভ্রান্ত ছাড়া কিছুই হওয়া হল না আমাদের

আমরা এরপরও প্রার্থনায় বসব
অধিকারের জন্য
তাক লাগানো ভবিষ্যতের জন্য

3 comments:

  1. খুব ভালো অনুবাদ। যাতনার চিহ্ন।। সময় থেকে রক্ত পড়ছে-প্রীতম বসাক

    ReplyDelete