অর্ক অপু


বাক্‌ ১৪১ ।। মোহনা মন্থন




১.
ভাড়াবাড়ির ছাদে একলার রাতগুলোতে যে ঘন জ্যোৎস্না মেখে ছিল আমারে, যত্ন হাতের স্পর্শে তারা ফিকে হয়ে গেছে, বহু পুরোনো প্যাকেট খোলা চিপসের মতো লবণ ধরে রেখেছে। মানুষের গায়ে যে এমন লবণ থাকে তার স্বাদ পেয়েছি তোমার ঠোঁটের সমুদ্র থেকে সরে গিয়ে, সরু নদীর মতো সর্পিল তোমার গলা পেরিয়ে, সমতল ছুঁয়ে ছুঁয়ে। এমন স্বাদের লোভেই কী শিরা-উপশিরার জলস্রোতে, রক্তের নহরে, সমুদ্র ছেঁড়ে ঝাঁক বেঁধে দেখা দেয় ইলিশের দল। পাখনার ঝাঁপটায় ভেতরে ভেতরে তুমি মাতাল হয়ে, আদিম বাসনায় আমার সমস্ত জ্যোৎস্নারে হালকা করে উড়িয়ে দাও, কোন আকাশে! আমি তো তার কিচ্ছুটি পাই না টের। আমার একলারে বিজ্ঞাপনের ভাষার মতো তুমি উত্তপ্ত করো, তুমি গতি দাও, তুমি ছোটাও; আমি বাজারের দিকে ছুটি তাজা পাব বলে মাছ ও সবজি সবুজ।

ভাড়াবাড়ির ছাদে আমার একার রাতগুলোতে আমি অসংখ্য নৌকারে নামিয়ে নিয়েছিলাম সম্ভাবনার শৈশব গলিপথ ধরে ধরে। তারা তো দৃঢ়তার বৈঠা বেয়ে বেয়ে সমুদ্র ছোঁবে বলে চলে গেছিল মোহনার কাছাকাছি। যত্ন হাতের ছলায় মাঝিদের করে দিলে ক্লান্ত এমনই?— আর তারা ভেবে পায় না জল কেটে কেটে কীভাবে উড়ে যায় কাঠের হাঁস। এত ছোট ঘাটে কীভাবে এত এত নৌকা করেছিল বসবাস! 

আমার একলারে সাঁতার শেখানোর নাম করে করে তুমি ছুঁড়ে দাও কোন সাহারায়। আমি ঘেমে যাই, আমি ঘেমে যাই তবু আমি নেমে যাই খুঁজে পাব বলে আদিম তৃষ্ণায় একটু জলের পথ। আমারে এমন শপথ করিয়ে তুমি মহাজনের মতো তোষকের গদিতে বসে হিসাব নাও আর বাক্সবন্দি করো আসলের সুদ। আমি দিয়ে যাই, আমি দিয়ে যাই তোমারে আমার ঘন জ্যোৎস্নার রাত, আমার নির্জনতা, আমার একাকীত্বের ভ্রমণ, আমার এলিয়ে থাকার সুখ। তবু তুমি অভিযোগ করে যাও অপ্রাপ্তির, বলে যাও ঠোঁটকাটা প্রতিবেশীর মতো বিরাম চিহ্নহীনতুমি কী দেখো নাই, নিজের বলে যা কিছু আছিল তার সমস্তই বিসর্জন দিয়েছিল কবি দেবী দরশনে। তবু ভোর রাতে তুমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদো?

২.
কবিতায় বলব,
আমি কবিতায় বলব সকালের মিহি রোদ দুপুরের গাঢ় তেজ পেরিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে
ঘন চিন্তায়। খোলা মাঠ, জল সাঁতার, ব্যর্থ সবুজ,
আকাশ তামাটে নদী এক-এক করে
ঢুকে যাচ্ছে কালকেউটে
ভারবাহী জীবনের পকেটে। তবে কী সবই পোক্তহতাশা, আশারে করে খুন,
মেঘের ওপাড়ে জমা রেখেছে
স্বপ্ন বুনবার ভ্রূণ! ক’পাটি জুতো পরে হাঁটে সে—
কোথাকার অতীতের জাবর কাটে মরণ মোহনায়?
গায়ের তার কোন বুননের জামা? কী খায় সে, অবশ আবেশে?
আমি কবিতায় বলব, হাসো
ভ্রূ কুঁচকে বলবে তুমি, ‘ভালোবাসো?

কবিতায় বলব
আমি কবিতায় বলব সরকারি হাওয়া
গাছ-বন ব্যর্থ সবুজ নাড়িয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে
চাকরির গুমোটে। পকেটে বেতনের নামে
রং করা খামে, এক-এক করে
ঢুকে যাচ্ছে কালকেউটে শিউলি ঘ্রাণ, পাঁচিল ঘেরা ফল চুরি বাগান, টেক্কার তাস ফিঙে শিশুবেলা অবহেলা পেয়ে পেয়ে ঘুমিয়ে গেছে
নাকে তার খেজুর রসের ঘ্রাণ লেগে আছে এখনো কুয়াশায়,
চাঁদ ঢেকে যায়, তারা ঢেকে যায়, শরীরে নোনা জাগে বাতাবি ওমে ডাকে স্বপ্ন বুনবার ভ্রুণ! 
গায়ের তার কোন বুননের জামা? কী খায় সে,
হেসে ভালোবেসে আমারে করে খুন।

কতক মাছ আটকে আছে জলাশয়ে
আমরা কয়েক পালিয়েছি সাঁতার ভয়ে
কেঁদেছি, ঘুমিয়েছি, শিখেছি হাঁটা
হঠাৎ দেখি লেজ নেই পা জোড়া ফাঁটা।

৩.
গভীর আঁধারে ইঞ্জিন গাড়ি ঘুম ভাঙিয়ে দেয় দোকান পাড়ে বেঁধে রাখা ঘোড়াদের। ঘোড়াগুলো নড়ে চড়ে চিৎকার করে—  যেন প্রতিশোধ নেবার তাড়নায় ফিরে আসা শেয়াল দলের ভয়ে মালিকেরে ডাকছে মুক্তি মুক্তি স্বরে।  শেয়াল নয়, গাড়ি থেকে নেমেছে কয়েকজন মানুষ— এই ঘ্রাণে আশ্বস্ত ঘোড়ারা আবার ডানার স্বপ্নে দু’-একবার রাজনৈতিক লেজ নেড়ে নিঃশব্দে উড়ে যায় রূপকথার শান্তির কাছাকাছি। অতীত কারও কারও কাছে টনিকের মতো, আরামের। দিনের শ্রমের পর নির্জন সন্ধ্যায় রূপকথায় ভেসে বেড়াবার মতো আরাম। এমন আরাম দলছুট পাহাড়ি বালিকা দিতে পারে না সুগন্ধ বিলিয়ে দিয়েও, পরিচয় অভাবে। একটা পরিচয় খোঁজে উন্মুখ থাকা ঘোড়ার মালিকও শব্দ চায়, গল্প চায়— হোক বানানো, যেমন ইচ্ছা। ঘোড়ারা ঘুমিয়ে গেলে কয়েকটা মানুষের সতর্ক পা টিপেটিপে এগিয়ে আসে কাঠের দালানের কাছাকাছি। ছড়িয়ে দেয় কাঠের দেয়ালে কেরোসিন জল, যেন না ধরে ঘুণ। এ কি আগুন!

শেয়ালেরা ঝরনা জলের পাড়ে, আগুন হলকায় মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, বাতাসেরা গান গায় হুক্কাহুয়া!

৪.
অনেক ঘাটের জল খেয়ে খেয়ে, আমার শৈশব ফোয়ারার স্বাদ আরও আরও উজ্জ্বলতা পেয়ে পেয়ে হয়ে উঠে ক্রমশ নিখাদসেদিকে তাকিয়ে নিরুর নাকফুল আলোর মতন ঝিলিকে, গ্রামের সাদামাটা সবুজ পেরিয়ে শুদ্ধ নদীর দিকে, এখনও দেখি মেলা বয় আর বিকিত হয় সংসার গুছানোর দা বঠি ফুল মাটির পুতুল।

শৈশবে সামান্য ভুলে ভেঙে যেত আমাদের পুতুলের বিয়ে, আড়ি নিয়ে নিয়ে কত কতদিন আমরা সাঁতারে যাইনি শুদ্ধ নদীর কোলে, সেখানে আমাদের মিল হয়ে যায় বলে, আমাদের ছিল কত কত দূরে থাকা?

ঘাটে ঘাটে তোমার মতন শাড়ি পেঁচিয়ে ধরে, ঘাটে ঘাটে তোমার মতন কত কত নারী, তোমারে দেওয়া আলতা পরে হাঁটে আমার বুকের মাঠে। আমি জলে নামি, আমি সাঁতারে ঘামি, শুদ্ধ নদীর ঢেউয়ে কল্লোল বয়ে যায়, সে কি হারায়? তার এলেবেলে হারিয়ে যাওয়া কই? হারিয়ে যাওয়ার কথাতেই মনে পড়ে ফোয়ারা, এখনও আমি তোমার কতকিছু হই।

৫.
তোমার শরীর জাগাইতে আমি যে শ্রম দিয়া গেছি, তারে মূল্যহীন কইরা তুমি নিরাশায় আত্মহত্যায় গেলা? তোমার কাছে জীবনডা এমনই খেলা? মনে হইতাসে, মাটিরে ভেদ করা যোদ্ধা চারারে, জিহ্বার একটানে মুখে পুইরা লইলো খামার থিকা ছুট দেওয়া এক বাছুর।

তোমার লিগা সস্তার চাষিরা ঘাম ঝরাইয়া আইনা দিছিল চাইল-ডাইল। তোমারে সাজানের লিগা মুখস্থ দর্জিরা সেলাইয়া গেলো কত তো রংবেরঙের কাপড়। তোমার লিগা ইটের পর ইট গাইতথা বানান হইল বাড়ি-মসজিদ-মন্দির। তোমার অসুখের রাইতে বড় রাস্তার ধারের ওষুদ বেচা বেডাডা মাঝরাইত তরি খোলা রাখছিল দোহান। আমাগো বাড়ির পুবধারে, নিজেগো সব বেইচা স্কুল বানাইছে আক্কাস আলির শহরফেরত ছোড পোলাডা। আর তুমি বাছুরের মুখে হুইততা পরলা?

ভাতের বাসনে পাথর দেইখা তুমি চাইলের দোকানের চামার আলিরে গাইল দিতা। আর তোমার মাও যে চাইল থিককা একটা-একটা কইরা পাথর বাইছা বানাইতাসিল তোমার লিগা পথ! গার্মেন্সে তোমার বইনরে ঠকায় বইলা তুমি মালিকের চৌদ্দগুষ্টিরে গাইল দিতা, আর তোমার বইন যে তোমার লিগা বানাইতাছিল স্কুলের সৌন্দর জামা। আমাগো বুয়ের চিকিসসা করব বইলা শহরের ডাক্তারি ছাইড়া আক্কাস আলির ছোট পোলাডার ইটের পর ইট গাইতথা তুলল নয়া ঘর। পোলাডার সাহসডারে তুমি এমনেই ধসায়া দিলা?

এত এত জোয়ান শ্রমিক, গতরে আহে নদীর স্রোতের লাহান ঘাম। হাতুড়ি শাবল লইয়া পুথির দাদুর লাহান বাজনা বাজায়, আর গইরা তোলে রাজা-রানি-উড়াল-গাড়ি-মেকাপ নারী। তুমি সব কিছু অস্বীকার কইরা আত্মহত্যায় গেলা? তোমার কাছে জীবনডা এমনই খেলা? মনে হইতাসে, মাটিরে ভেদ করা যোদ্ধা চারারে, জিহ্বার এক টানে মুখে পুইরা লইল খামার থিকা ছুট দেওয়া এক বাছুর। দামে এমুন ঠকাইলা আমাগোরে?

৬.
মসজিদের আস্তর ভাঙা সিঁড়িতে অসংখ্য বর্ণিল জুতোর ভিড়ে নিজেকে দেখতে পেয়ে মোনাজাতের মতো নীরবে বলেছি—  ‘নিয়ে বসে আছি ছেঁড়া ফ্যাকাসে জীবন।’ আমার বহু তালি পট্টি দেয়া সেলানো কথা শুনছ না ঈশ্বর। তোমাকে বধির ভেবে আমিও কি উচ্চস্বরে চেঁচাব তবে? এতে তোমার আলোচিত নামের ইজ্জ্বত থাকবে?— সেই বধির নারীটির কাছে, তাহাজ্জুদ পড়বে বলে যে ওজু করে বসে আছে, নকশা জায়নামাজে।

ঈশ্বর সেলাই করে দাও জুতোর মতো জীবন— যত্রতত্র সে ছিঁড়ে আছে

24 comments:

  1. খুবি সুন্দর লেখনি আপনার।আমি যদিও আবৃত্তি ভাল পারিনা তারপরেও আপনার লেখনি পড়ে গোপনে আবৃত্তি করেছি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমাকেও শোনাতে পারেন, খুব খুশি হবো।

      Delete
    2. চায়ের দাওয়াত দিলে রাজি হতে পারি

      Delete
    3. অবশ্যই অবশ্যই

      Delete
  2. Apu's poetry portray a skilled hand's composition of inner realities, fantasies and own spirits. His words ambush corruption, unpromised love and beliefs. He has shown stylistic mastery which develops through questions, answers and unanswered thoughts left for readers.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমাদের অনেক আলাপ বাকি এখনো,
      পাহাড়ের ভাঁজে ঝরণা দেখতে গিয়ে আমরা কী উচ্চারণ করতে পারি না শ্লোক ও যাপিত জীবনের শোক।

      Delete
  3. বাহ্,দারুন। বিচিত্র ভাষা শৈলী বরাবরের মতই মুগ্ধ করেছে আমাকে। দুর্দান্ত চিন্তাধারা!

    ReplyDelete
    Replies
    1. পাঠে থেকো, পাঠে রেখো

      Delete
  4. খুব খুব ভালো লেগেছে আমার, অর্ক

    - আম্রপালী

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভালোবাসা প্রিয় আয়না

      Delete
  5. বাহ্!বরাবরের মতই খুব ভাল লাগল❤

    ReplyDelete
  6. বরাবরের মতোই নতুন ভাবনার খোরাক যোগায় আপনার লেখা। প্রতিটি লেখা স্বতন্ত্র ও সুন্দর

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভাবনা ছড়াক অভেদের দিকে

      Delete
  7. বাহ্!মুগ্ধতা জানবেন কবি ।

    ReplyDelete
  8. Impressive to read the story of soil-human beings. Diction, language depict the root form of our society. Appreciate for writing on deprived sector of our society. It's a brilliant point of view.

    ReplyDelete
  9. Replies
    1. বাহ, খুব কাছাকাছি নাম

      Delete
  10. ভালো লাগলো কবিতা।আনন্দ পেলাম।

    ReplyDelete
  11. শুভেচ্ছা তোমাকেও

    ReplyDelete