রাজদীপ ভট্টাচার্য

বাক্‌ ১৪১ ।। ক্রিমের কৌটো ।।



সমীরকাকু আমাদের কেউ হন না। অথচ আমরা বিষয়টা জানতামই না। তখন আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। আর আসলে তা ভিতরে ভিতরে আরও অনেক বড়। গোটা পাড়া জুড়ে যেন ছড়িয়ে আছে পরিবারিক বন্ধন। ছিন্নমূল মানুষদের নিয়ে একটা সদ্য গড়ে ওঠা কলোনিকেউ যশোর, কেউ খুলনা। আমাদের গলিতে সবাই লতায়পাতায় আত্মীয়। বাবার খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো ভাইদের দল বেঁধে পাশাপাশি বাড়ি। তখনও আমাদের ঢালাই হয়নি। টালির চাল। ইটের দেয়াল। কাঠের ফ্রেমে টিনের জানলা। ছোটো-ছোটো ঘর। কাকা-জ্যাঠা কিংবা আমাদের ঘরের কোনো প্রভেদ নেই সারাদিন। শুধু রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় নিজেদের ঘরের কথা মনে পড়ে। এমনকি পাড়ার বন্ধু বান্ধবদের ঘরদোরও তখন আমাদের কাছে খোলা মাঠ।
এইরকম সময়ে সমীরকাকুও আমাদের জীবনযাত্রার একটা অপরিহার্য অঙ্গ হয়েই ছিল। মাঝেমাঝে আচমকা তার আবির্ভাব। ব্যস, হয়ে গেল। সমীরকাকু আমায় অঙ্ক দেখাবে। বোনকে ড্রয়িং শেখাবে। ভাইকে ইংরেজি পড়াবে। মা-কাকিমাকে ঘটিঘরে রান্নার সুলুকসন্ধান দেবে। ঠাকুরদার কাছে দেশের বাড়ির খবর, গ্রাম থেকে আসা নতুন মানুষের মুখ থেকে শোনা টাটকা সংবাদ পৌঁছে দেবে। আমরা ছোটোরা আহ্লাদিত হব তাকে পেয়ে। সমীরকাকু যেন আমাদেরই বন্ধু। মায়েরা আনন্দিত সমীর ঠাকুরপোর তত্ত্বাবধানে। মা আর সেজোকাকিমার ঝগড়াঝাটি রেসারেসি ক’দিনের জন্য বন্ধ। ঠাকুরদার মুখে হারিয়ে যাওয়া অচেনা আলো। সমীরকাকু মানে যেন একটা ম্যাজিক। সমীরকাকু মানে দেশ-গাঁয়ের গন্ধ। সন্ধে হলে দালানে বড় পিতলের গামলায় মুড়ি মাখা হবে পিঁয়াজ আর নারকেলকুচি দিয়ে। বাড়িতেই চপ, পিঁয়াজি ভাজা হবে। লিকার চা। আর তার সঙ্গে অনুপানে শুধু দেশ, দেশ আর দেশের গল্প। নদীর কথা, মাছের কথা, ধান-পাটের কথা, উঠোনের কাঁঠাল গাছের কথা। রাত বাড়ার সাথে সাথে আলোচনা ক্রমশ জমে উঠত, আর যশোর জেলার সেই অকিঞ্চিৎকর গ্রাম নেমে আসত আমাদের উঠোনে। সমীরকাকু সেই মন্ত্রটা জানত। কিভাবে সেই গন্ধ, সেই সময়কে নামিয়ে আনতে হয় নাগেরবাজারের এই কলোনির ঘরে। বলে উঠত, ‘তোমার মনে আছে ফুলদা সেই যে বছর বন্যায় হেমেনবাবুদের কাছারিবাড়ি ভেঙে পড়েছিলো? কী প্রলয় বৃষ্টি। টানা আট-দশ দিন চলতাসে।
অমনি তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের এক সময়ে ফিরে যেত সবাই। তার আগেপিছে কী-কী ঘটেছিল সব, সব কথা দুমড়েমুচড়ে বেরিয়ে আসত। কত আবেগ, ভালোবাসা। যেন পরম যত্নে কেউ প্রাচীন তোরঙ্গ থেকে বের করে আনছে সেই কবেকার বিয়ের বেনারসি।
তখনও ছোটকার বিয়ে হয়নি। তাই রাতে ছোটকার সঙ্গেই তক্তপোষে শুয়ে পড়ত সমীরকাকু। দু’দিন, তিনদিন থাকার পরেই আচমকা উড়ে যেত পাখি। ইস্কুল থেকে ফিরে দেখতাম ছোটকার ঘর আবার যেন শূন্য খাঁচার মতো শুনশান। সবাই ফিরে যেত যে যার দিনাতিপাতে। সকালবেলা টাইমকলে জলের জন্য ঝগড়াঝাটি। কেরোসিন তেলের লাইন। ঠাকুমার গজগজানি। রাতে বাবার কাছে মায়ের অভিযোগ। ঠাকুরদার চোখজুড়ে অব্যক্ত উদাসীনতা। এভাবেই আবার আমরা ফিরে আসতাম নাগেরবাজার কলোনির অভাব অনটন দুঃখ যন্ত্রণার জীবনে।
          পুনরায় কয়েকমাসের অপেক্ষা। কবে সমীরকাকু আসবে ফের। দেখা হলে আমরা প্রথমেই জিজ্ঞেস করতাম, ‘এতদিন কোথায় গেছিলে কাকু?’ ব্যাপারটা এমন যেন সমীরকাকু এখানেই থাকে, দু’দিনের জন্য কোথাও একটা উধাও হয়েছিলআবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে।
          সমীরকাকু গুছিয়ে খুলে বসত তার গল্পের ঝুলি। ‘আরে সেই পুরুলিয়ায় শুটিং চলছিল টানা। কি বলব, একদিন সেটে হাতির পাল আইসা হাজির। আমরা কোনোমতে ক্যামেরা হাতে পগারপার।’
          কাকুর কথা অনুযায়ী বাংলা সিনেমার অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেকটরের কাজ করতে এখানে-ওখানে ছুটে বেড়াতে হত তাকে। আর আমাদের কাছে তখন সিনেমা মানেই একটা মোহময় ব্যাপার। যদিও কাকুর ওই ক্ষয়াটে চেহারা, মলিন পোশাক আর বেঁটেখাটো উপস্থিতি কেমন একটা সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি করত মনে। তবু টিভি বা সিনেমার পর্দায় দেখা প্রিয় মানুষগুলোকে এত কাছ থেকে দেখার ফাস্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতার টাটকা বর্ণনা যখন কাকুর মুখে খই-এর মতো ফুটত, তখন তা অবিশ্বাস করার সাধ্য কারুর ছিল না। মা, কাকিমারাও খুঁটিয়ে জেনে নিত সাবিত্রী চ্যাটার্জি কিংবা মাধবী মুখার্জির চলন-বলন। আমিও কোথাও মনের মধ্যে গোপন আশা পুষে রাখতাম যে ভবিষ্যতে কাকুর হাত ধরে হয়ত সিনেমার জগতে আমারও কোনো দরজা খুলে যেতে পারে।
          একবার সমীরকাকু তখন বাড়িতে এসেছে। খাটের ছতরি থেকে ঝোলানো ফতুয়ার পকেটে হাত দিতেই অনুভব হল একটা গোল বাক্স। বের করে দেখলাম নিভিয়ার বিদেশি টিনের কৌটো। স্নান সেরে ফিরতেই কাকুকে ধরলাম, ‘তোমার পকেটে ক্রিমের কৌটো কেন গো?’
          একগাল হেসে সমীরকাকু গল্প শুরু করল। ‘আরে এখন আসতাছি সেই বেতলা ফরেস্ট হতে। হেই ডালটনগঞ্জ। সত্যজিৎ রায়ের নতুন সিনেমার শুটিং চলতাছিল। সেখানেই শর্মিলা ঠাকুরের লগে আলাপ হল। তারে জিগাইছিলাম, আপনে কি ক্রিম মাখেন যে এমন ফরসা? টোল ফেলাইয়া একগাল হাসল, পাশেই রাখা ছিলো এই কৌটা। তাই তুলে নিলাম পকেটে।’
          কাকিমা আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে কৌটো নিয়ে নাম পড়তে শুরু করল। সমীরকাকু বলল, ‘ও তোমাদের দেখে লাভ নাই। রোজ অমন একটা গোটা কৌটোর ক্রিম সারা গায়ে ঘষে। তবে না অমন জেল্লা!  আর ওই ক্রিম লাগানোর জন্যেও তার সাথে মহিলা রাখা আছে। সে চুল আঁচড়ে দেয়। কাপড় পরায়ে দেয়।’
          মা, কাকিমা হতবাক হয়ে শোনে অমন মজার কথা। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির শেষে সেই পর্দায় দেখা রূপসী নায়িকার রূপের গোপন রহস্য, জীবনযাপন জেনে লাভ না ক্ষতি হল তাই বুঝি ভেবে দিশেহারা হয়।
          এভাবে সমীরকাকু মানেই যেন একটা ম্যাজিক। মায়াবী আলো। শীতের দেশে বসন্তের হাওয়া। গুমোট হয়ে থাকা মন সহসাই ভালো হয়ে যাওয়া।
অনেক দিন পরে তখন ঠাকুমা আর জি কর হাসপাতালে ভর্তি। বাবার সঙ্গে সেদিন ভিজিটিং আওয়ার শেষে বাইরে বেরিয়েছি। ফুটপাত ধরে বাবা হেঁটেই চলেছে। বলি, ‘কোথায় যাচ্ছ বাবা? বাসে উঠবা না?’
          না, চল, সমীররে মায়ের খবরটা দিয়া আসি।’ সেই একবার আমার সমীরকাকুর বাড়িতে যাওয়া। খাল ধারের বস্তি। গলি, তস্যগলি। ছোট্ট একচিলতে ঘরের সামনে এজমালি কলতলায় লুঙ্গি পরে বাসন মাজছে বাংলা সিনেমার অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেকটর সমীর দত্ত। দেখে হতবাক হয়েছিলাম। যে মানুষটা আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো, নায়কের বাড়া। তার এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত জীবন, খুপরি ঘর, ময়লা চাদর— এসব দেখে হজম করতে পারছিলাম না। ফেরার পথে বাবাকে বললাম, ‘তোমার কেমন ভাই হয় সমীরকাকু?’
          বাবা বলল, ‘দূর, আমার ভাই হতে যাবে কেন? ও আমাদের দেশে এক গ্রামের ছেলে। তাই ভাই আর কি!’
          আচ্ছা, কাকু তো সিনেমার ডিরেকটর। তাইলে এখানে থাকে কেন?’
          রাখ তোর ডিরেকটর! অ সমীরের সব গুলতানি। ছোটোবেলা থেকেই ওইটার ঘুরন রোগ আছে। কোথাও তিষ্টোতে পারে না। আজ এখানে কাল ওখানে। সিনেমার দলের সাথে কিছু ফাইফরমাস খাটতে যায়।’
          এতদিনের বিশ্বাস এককথায় ভাঙার নয়। বাবার কথায় মন খারাপ হয়ে যায়। ভরসা করতে ইচ্ছে করে না। এদেশে তখন আমাদের ভিত শক্ত করার সময়। তাই দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামে সময় ঘুরে যায় দ্রুত। সেই টালির চাল একদিন পাকা হয়। কিন্তু শিকড় ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। দেখতে দেখতে ঠাকুরদা, ঠাকুরমা দুজনেই চলে গেলেন খুব কম সময়ের ব্যবধানে। হাঁড়ি আলাদা হয়ে গেল একে-একে। দেশের গন্ধ চাপা পড়তে শুরু করল রোজকার ক্লেদ আর আত্মনিগ্রহের আড়ালে।
          তারপরেও দীর্ঘকাল যোগাযোগ ছিল। মাঝেমধ্যে আসা-যাওয়া হত। ততদিনে বাবা ব্যবসায় খানিক জমিয়ে বসেছে। মোড়ের মাথায় আমাদের বই-এর দোকান। কলোনিতে গড়ে ওঠা নতুন ইস্কুলের ছেলেমেয়ের ভিড় জমে থাকে সকাল-বিকেল। সমীরকাকু এলে বাবা ভালোবেসে দু’-চার পিস মাছ জোর করেই খাওয়াত বসে থেকে। ইতিমধ্যে বাড়িতে টেলিফোন এসেছে। ঘরবাড়ির চেহারা-ছবি পালটেছে বিস্তর। আরও পরে সমীরকাকু পাড়ার মোড়ে কয়েন ফেলা ফোন থেকে ফোন করত। বোধহয় তখন আর আসার মতো শরীর ছিল না। বিয়ে-থা করে ওঠা হয়নি। ফলে নিয়ে আসার মতো মানুষও পাশে ছিল না কেউ। আমরাও ব্যস্ত হয়ে উঠেছি যে যার মতো।  তারপর একদিন বাবাই খবর আনল, মাসখানেক আগে সমীর দত্ত মারা গেছে।
          তখন আমি প্রাইমারি ইস্কুলে মাস্টারিতে ঢুকেছি সবে। সেই আমতায় ইস্কুল। সকালে বেরিয়ে ফিরি রাত সাড়ে সাতটায়। সেদিন বাড়ি ফিরে মার কাছ থেকে খবরটা পেয়ে থম মেরে বসেছিলাম অনেকক্ষণ। বই-এর তাকের পিছনে লুকোনো খোপ থেকে হাত গলিয়ে বের করে আনলাম সেই নিভিয়ার কৌটো। একসময় স্ট্যাম্প জমিয়ে রাখতাম এর ভিতরে। সমীরকাকু আমাদের কোনোদিন কিছুই দেয়নি। একমাত্র এই কৌটোটা কী করে যেন রয়ে গেছে। একটা প্রাচীন ক্রিমের কৌটো। নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিই বারবার। মলিন মৃদু সৌরভ। নিভিয়া ক্রিমের নাকি বিদেশি স্ট্যাম্পের! নাকি এ গন্ধ সমীর দত্তের! সমীরকাকু আমাদের কেউ হতেন না। তবু গন্ধটা বড় চেনা চেনা লাগল আমার! 

No comments:

Post a Comment