শুভদীপ নায়ক

বাক্‌ ১৪১ ।। ব্যক্তিগত দর্শন: বাক্‌-স্বাধীনতা— ১ম পর্ব।। 



ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে জীবনের সম্ভবনাময় দিনগুলো। একটা মরা জ্যোৎস্নার রাত, অনেকটা দূরে পিছিয়ে গিয়েছে সমুদ্র। ভিজে বালির সৈকতে আমি হেঁটে যাচ্ছি মৃত্যুর দিক থেকে নতুন জীবনের দিকে। সেখানে নিজের একটা অবস্থান খুঁজে নিতে। মাঝেমাঝে রাতের আকাশে যখন জ্যোৎস্নার চাঁদ থাকে না, সেখানে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা তারাদের মাঝে আমি ভেসে উঠতে দেখি অসংখ্য মানুষের মুখ। যেসব মানুষ জীবনের দিক থেকে সামুদ্রিক বাতাসের মতো ছুটে আসে মৃত্যুর দিকে, তাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা কাজ করে। কিন্তু এখানে কোনও প্রতিযোগিতা নেই। পৃথিবীর সমস্ত ব্যস্ততা সরিয়ে রেখে লিখতে বসার এইটাই সঠিক মুহূর্ত।
মৃত্যু কি জীবনের চেয়ে বড়? নাকি জীবনই বিশাল? কিংবা বলা যেতে পারে অনন্ত, সীমাহীন। অথচ জীবনের সবকিছুই তো মৃত্যুর দরজায় এসে থেমে যায়। তারপর আর জীবন বলতে তেমন কিছুই তো পড়ে থাকে না। তবু সেই মৃত্যুর মধ্যে এসেই জীবনের যাবতীয় অর্থ খুঁজে বেড়ায় মানুষ। এক অর্থে, জীবন যখন শেষ হয়ে আসছে, ফুরিয়ে আসছে বেঁচে থাকার সম্ভবনা, ঠিক তখনই মানুষের মনে মৃত্যু সম্পর্কে রহস্য দানা বাঁধে। এই যে এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি সমুদ্রের মুখোমুখি, রাত্রি এখন অনেক, জনশূন্য সৈকতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আমার সমস্ত জীবন ভেসে যাচ্ছে রাত্রি-সাগরের অগাধ জলধিতে। মানুষের জীবন, তার সমস্তকালের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সবকিছুই একটা সময়ের পর ভেসে যেতে থাকে। আমি একদিন কল্পনা করেছিলাম, আমার মাথার ওপরে তরল আকাশ, আর পায়ের নীচে সবুজ ঘাসের জমিতে প্রতিদিন জমে উঠছে দুঃখ। সেই দুঃখের সমূহ বেদনা ফাটিয়ে বেরিয়ে আসছে মানুষের যাবতীয় লেখালিখি। সেটা কবিতাই হোক, অথবা কোনও গদ্য। আবার এই জমাট দুঃখগুলো একপ্রকার ছবিও হতে পারে। পৃথিবীর সেই সব লেখকেরা, যাঁরা আসলে প্রত্যেকটা ভালবাসার কথা লিখেছে জন্ম-মৃত্যুর আদলে, তাঁরা চিরদিনই কোনও-না কোনও দোলাচলে ভুগেছে। এই অসমাপ্ত পরিস্থিতিই আসলে সত্যিকারের লেখার প্রাণ। প্রতিটি মহৎ সৃষ্টির মূলে লুকিয়ে আছে তারই একটা ঘূর্ণিঝড়। এই ঝড়, এই বিধ্বংসী অভিপ্রায় না থাকলে, কখনোই কোনও সৃষ্টি অনন্তকালের হয় না। তাৎক্ষণিক জীবনের সঙ্গে মৃত্যু পরবর্তী জীবনের এইটাই তফাৎ। এই পার্থক্য প্রতিনিয়ত একটু একটু করে বাড়তে থাকে। একজন লেখকের কাজই হল দুটো অবিশ্বাস্য জীবনকে এক দর্শনে এনে মিলিয়ে দেওয়া। এর মানে আমি কিন্তু কখনোই এটা বলছি না যে আমি মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অস্তিত্বে বিশ্বাসী, কখনোই না। বরং, ঠিক উলটো ব্যাপারেই বেশি বিশ্বাস আমার। আমি মনে করি, মৃত্যুতেই ফুরিয়ে যায় একটা মানুষের আরও খানিকটা কাজ করার সুযোগ। হয়তো আরও খানিকটা কাজ, কিছুটা ভাবনা রাখা ছিল তার চিন্তার ভিতরে। মৃত্যুতে তার সেই কাজ, তার সেই ভাবনা চিরকালের জন্যে নষ্ট হয়ে গেল। তবে হ্যাঁ, যে জীবন কখনোই মুছে যায় না মৃত্যুতে, যে জীবনকে বারবার ফিরে পেতে হয় তার রেখে যাওয়া কাজে, আমরা বলতে পারি, সেই জীবনই তো পেরেছে মৃত্যুর ওপর জয়ের নিশান ধরে রাখতে।
মৃত্যুকে নিয়ে অনেক লেখাই হয়েছে পৃথিবীতে। জন্মকে নিয়েও লিখেছে মানুষ। জীবন নিয়েও লেখালিখি হয়েছে বিস্তর। তবু কেন মৃত্যু আমাদের শিহরিত করে? জন্ম আমাদের যতটা অবাক করে, তার চেয়েও কেন মৃত্যু আমাদের বেশি করে ভাবায়? কারণ, মৃত্যুর রাস্তা একরৈখিক। সেখানে প্রবেশ-দুয়ার পেরিয়ে একবার ভিতরে ঢুকে পড়লে ফের আসার রাস্তা হারিয়ে ফ্যালে মানুষ। পৃথিবীতে বহুকালব্যাপী যে মানুষটা চলে-ফিরে বেড়িয়েছে, একদিন তারও সময় হয়ে আসে শ্রান্ত হয়ে ওঠার। ঠিক তখনই ঝরে যেতে হয় তাকে, পড়ে যেতে হয় তাকে পৃথিবীর কোথাও তার আর কোনও চিহ্ন পড়ে থাকে না। কোনও এক মহাশূন্যের গহ্বরে তাকে চিরকালের মতো হারিয়ে যেতে হয়। বাকি যারা রইল, তারা ধীরেধীরে ভুলতে শুরু করে তাকে। সকলের স্মৃতি থেকে যখন একটা মানুষ চিরতরে মুছে যায়, তখনই সে প্রকৃত একা হয়। তার সর্বস্ব হয়ে ওঠে নির্জন। এক-একটা মৃত্যুর কথা টের পেলেই মানুষ বুঝতে পারে, আনন্দময় জীবনের শেষে মৃত্যু নামক ভয়ঙ্কর সত্যটা তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। একজন সত্যিকারের লেখক জীবনসত্যের জন্য সংগ্রাম করে। সে চায় তাঁর ভাবনা, তাঁর অনুভূতিগুলো, তাঁর যাবতীয় আত্মকথন, তাঁর অস্তিত্ব ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও পৃথিবীতে পড়ে থাকুক। তবেই মানুষে-মানুষে সম্বন্ধ তৈরি হবে।
যে মানুষ পৃথিবীতে এসেছিল আমার জন্মের আগে, যাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, কিংবা যে সমস্ত মানুষের জন্ম আমি মারা যাওয়ার অনেক পরে হবে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় মৃত্যুরই মাধ্যমে। সেই কারণে, আমরা যা পাই না, সমস্ত জীবনভর আমরা তাই-ই পাওয়ার চেষ্টা করি। কেননা, আমরা জেনে গিয়েছি মৃত্যুর পর আমাদের কোনও প্রাপ্তি নেই। আমরা বন্ধুতা পাব না, টাকাপয়সা পাব না, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পাব না, কিছুই পাব না। বিষয়-সম্পত্তিও নিয়ে যেতে পারব না। এমনকি, আমাদের কামনা-বাসনাও অপরিপূর্ণ রয়ে যাবে আমাদের মৃত্যুর পরে। পৃথিবীতে আমরা চিরদিনের কয়েদি নই’— এই কথাটা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছিল। মৃত্যুর মতো সত্যিকারের শোককেও ভুলে এতকাল ছিলাম আনন্দের সঙ্গে। অনেক মানুষের সঙ্গে বন্ধুতা, প্রেম ও সৌজন্যের সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল আমার। কিন্তু জীবনের যে স্থানে সত্যিকারের নির্ভরতা গড়ে ওঠে, সেখানে এসব কোনও কিছুরই প্রয়োজন হয় না। সম্পর্কগুলো ভাঙল একে-একে। সৌজন্যগুলো অনুষ্ঠানের মতো এক সময় ফুরিয়ে এল। এক-এক করে যখন সেগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে, দিনের পর দিন যখন কেউ আর তেমন আগের মতো যোগাযোগ রাখতে চাইছে না, তখন বুঝতে পারছি, এই ঠিক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। সম্পর্কগুলো ভেঙে গেলে অবশ্যই বেদনা অনুভূত হয়, কিন্তু নিজের মধ্যে মানুষ টের পায় কোথায় যেন তার মুক্তি হচ্ছে। এতদিন পর একা হতে পেরে মানুষ হয়তো অবলম্বন হারায়, তবু সে অত্যন্ত সজীব হয়ে ওঠে।

(ক্রমশ)

No comments:

Post a Comment